বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বাঁশশিল্প
ঘনিরামপুর নদীরপাড় পাটনীপাড়া গ্রামের বিনোদ বিহারী। বয়স ষাটের কাছাকাছি। বাপ-দাদার দেখানো পেশার সাথেই তার নিবিড় সম্পর্ক। পরিবারের অন্যরাও এই শিল্পকে পেশা হিসেবে আগলে রেখেছেন।
বংশ পরম্পরায় এই শিল্প নির্ভর কারিগরদের এখন আর আগের মতো ব্যস্ততা নেই। নেই তাদের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও। হারাতে বসেছে বাঁশের তৈরি ডালি, কুলা, চালন, চাটাই ও খাঁচা। এক সময় গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ব্যাপক চাহিদা ছিল পরিবেশ বান্ধব এসব পণ্যের। বর্তমানে হাতে তৈরি বাঁশ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে প্লাস্টিকের তৈরি পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এ হস্তশিল্প বিলুপ্তির পথে।
বিনোদ বিহারী বার্তা২৪.কমকে জানান, কৃষিকাজ ও গৃহস্থালিতে ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্রই বেশি তৈরি করেন তারা। বাঁশ দিয়ে কুলা, ডালি, খই চালান, মুড়ি চালান, খাটি, ডালি, চালুন, ধারার ডালি, মুরগি খাঁচা, টুকড়ি, ছাবা খাঁচা, ডোল খাঁচা, ডুলি, মাছ ধরা পলাই, চাংগাড়ি, বিয়ের চালুন, কবুতরের কাবু, খেলনা ঝুঁড়ি, রঙিন ডালাসহ অনেক সামগ্রী নিপুণভাবে তৈরি হয়। কিন্তু এখন আগের মতো এসবের চাহিদা নেই। প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্রের কাছে বাঁশ শিল্প এখন ধরাশয়ী।
এদিকে যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাঁশ শিল্প নির্ভর পরিবারগুলোতে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। আগের মতো বেচা-বিক্রি না থাকায় এসব কারিগররা অতি কষ্টে জীবনযাপন করছে। এভাবে চলতে থাকলে মুখ থুবড়ে পড়বে বাঁশ শিল্পের ভবিষ্যৎ। এমনকি বিলুপ্ত পণ্যের তালিকায় উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুর সদরের সদ্যপুষ্করণী, তারাগঞ্জের ঘনিরামপুর, গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ি ও মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ি এলাকাতে কয়েকশ’ পরিবার সরাসরি বাঁশ শিল্পের পণ্য তৈরি সাথে জড়িত। চাহিদানুযায়ী বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন আকার ও শৈলিতে ডালি, কুলা, চালন, চাটাই ও খাঁচাসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সাংসারিক সামগ্রী তৈরি হয়।
মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ির সেরুডাঙ্গা এলাকায়ও বেশ কয়েকটি পরিবার এই শিল্প নির্ভর। তাদের প্রতিদিনের সকালটা শুরু হয় বাঁশের চাটাই, ডালি, কুলাসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরির মধ্য দিয়ে। যুগ যুগ ধরে এখানকার নারী-পুরুষরা বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছে। অথচ তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন নেই। কথাগুলো কারিগর চিনু বালার। চার যুগেরও বেশি সময় ধরে তার মত আরো অনেকেই হাতে তৈরি বাঁশের সামগ্রী তৈরি করেছেন।
একই গ্রামের নন্দ কিশোর বার্তা২৪.কমকে বলেন, এখন একটা ভালো বাঁশ কিনতে গেলে চারশ' টাকার নিচে নেই। সেই বাঁশ দিয়ে কমপক্ষে আটশ' টাকার সামগ্রী তৈরি করা যায়। এর জন্য তিন-চার জনকে শ্রমও দিতে হয়। হাটে-বাজারে ঘুরে তারপরও সেগুলো বিক্রি করলে দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত টিকে থাকে। এভাবে দিন দিন সংসার চালানো কঠিন হয়ে উঠেছে।
এদিকে রংপুর মহানগরীর লালবাগ হাট ও সিটি বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বাঁশের তৈরি পণ্যের এক সময় খুব চাহিদা ছিল। তখন বিভিন্ন মৌসুমের আগে বাঁশের পণ্য সামগ্রী মজুদ করে রাখা হত। কিন্তু এখন তেমন চাহিদা নেই। সবখানে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার বেড়ে গেছে। এই পরিস্থিতি শুধু শহরে নয় গ্রামেও রয়েছে বলে তারা জানান।