'মোর লাইলির জন্যে কি কেউ নাই'
রংপুর টাউন হল চত্বর। বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টা। সাহিত্য মঞ্চের পাশে এক বৃদ্ধা আর একটি কুকুর। কাছে গিয়ে খানিকটা অবাকই হতে হলো। কুকুরটার পেছনের দুই পা নেই। পরম মমতায় তার মুখে রুটি তুলে দিচ্ছেন বৃদ্ধা রবিতোন বেওয়া।
রবিতোনের স্নেহমাখা পরশ এ পশুটাকেও প্রভুভক্ত করে ফেলেছে। কোনো নড়াচড়া নেই। গপাগপ রুটি গিলছে কুকুরটি। আশপাশের লোকজন বলছেন, টাউন হলে এ দৃশ্য প্রতিদিনের। রবিতোন বেওয়া কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কি যেন বলছিলেন। বোঝা গেল না।
একটু পর কুকুরটি দু’পায়ে ভর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। লাইলি লাইলি করে রবিতোন ডাকছিলেন। আশপাশে তখন কেউ নেই। আবার ডাক শুনে কুকুরটি ফিরে এল। ততক্ষণে ধারণা স্পষ্ট হলো এ কুকুরটির নামই লাইলি।
এবার কথা হলো রবিতোন বেওয়ার সঙ্গে। যার বয়সের যোগফল তিন কুঁড়ি পেরিয়েছে। তিস্তা নদী তার ভিটে মাটি সবই কেড়ে নিয়েছে। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। একমাত্র মেয়ে পরের ঘরে। টাউন হল চত্বরে সরকারি গণগ্রন্থাগার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে কিছু টাকা পান। তাই দিয়ে দিন কেটে যায়। গণগ্রন্থাগার ভবনের এক কোণে একটি ঝুপড়ি ঘরে কোনো মতো রাত কাটে তার। সঙ্গ দেবার কেউ নেই। বছর খানেক ধরে এ কুকুরটি (লাইলি) তার সময় কাটানোর একমাত্র সঙ্গী।
কুকুরটিকে এক বছর আগে চোখের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারাতে দেখেছেন রবিতোন। রাস্তা পারাপারের সময় মাইক্রোবাসের চাকায় পেছনের দুই পা থেতলে যায়। এরপর গুরুতর আহত কুকুরটির ঠাঁই হয় রবিতোনের ছোট্ট খুপড়ি ঘরে। রাস্তা থেকে তুলে এনে সেখানে চিকিৎসা করান তিনি। এখন কুকুরটি চলাফেরা করতে পারে, তবে চার পায়ে ভর করে নয়।
পঙ্গু লাইলির সেবায় তৃপ্ত রবিতোনের সঙ্গে কথা হয় টাউন হল চত্বরে। সেখানে আলাপকালে রবিতোন বললেন, শুধু ছবি তুললে হবে না, লাইলির খাবারের ব্যবস্থাও করে দিতে হবে। এর জন্য একশ’ টাকা লাগবে।
রবিতোন বলেন, কত মানুষের তো অসুখ হলে মানুষ সাহায্য সহযোগিতা করে। মোর লাইলির জন্যে কি কেউ নাই? সবাই সাহায্য করলে লাইলি আরো আগোত সুস্থ হইল হয়।' যেন লাইলীর খাবার আর চিকিৎসা নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত।
কথা বলতে বলতে জানা গেল, রবিতোন বেওয়ার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাচঁপীর এলাকায়। তিন দশক আগে নদী ভাঙ্গনে ভিটে মাটি হারিয়ে কাজের সন্ধানে রংপুরে পা রাখেন। প্রথমে একটি হোটেলে কাজ করতেন। পরে মাসিক দুইশ’ টাকা চুক্তিতে সরকারি গণগ্রন্থাগারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেন। এখন পান পাঁচ হাজার টাকা করে। এভাবেই টাউন হল চত্বরে কেটে যাচ্ছে রবিতোন বেওয়ার বছরের পর বছর।