সৌর সেচে বছরে জ্বালানি-বিদ্যুৎ সাশ্রয় ২৫ কোটি টাকা
রংপুরে দিন দিন বেড়ে চলেছে সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্পের ব্যবহার। জ্বালানি তেল নির্ভর সেচ মেশিনের পরিবর্তে কৃষকরা এখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে ঝুঁকছেন। আর এতে করে বছরে প্রায় ২১ কোটি টাকার জ্বালানি তেল সাশ্রয় হচ্ছে। সঙ্গে প্রতি বছর বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে সাড়ে চার কোটি টাকা।
কয়েক বছর আগেও এখানকার গ্রামাঞ্চলে সেচের জন্য জ্বালানি তেল ব্যবহৃত মেশিনের ওপর নির্ভর করতে হতো কৃষকদের। এখন সেদিন বদলে গেছে। সৌর বিদ্যুৎচালিত সৌর সেচ পাম্প কৃষকদের জ্বালানি নির্ভরতা দূর করেছে, কমিয়েছে ভোগান্তিও ।
এখন নেই ডিজেলের জন্য বাড়তি খরচ। নেই ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিং চিন্তা। বরং কয়েকগুণ খরচ কমে কৃষকের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় বেড়েছে। সঙ্গে নিশ্চিন্তে মিলছে সেচ সুবিধা। এখন প্রতি একর জমিতে বোরো মৌসুমে সেচের জন্য সাড়ে ছয় হাজার টাকা আর আমনে দুই হাজার চারশো টাকা খরচ হয় চাষিদের। রবি মৌসুমে খরচ মাত্র এক হাজার দুইশ টাকা।
রংপুরের বদরগঞ্জের রামনাথপুর এলাকার কৃষক আবু বক্কর। একটা সময় জমিতে সেচের জন্য তিনি ডিজেলচালিত সেচ মেশিন ব্যবহার করতেন। বার্তা২৪.কম-কে তিনি বলেন, ‘আগে প্রতিদিন বাড়ি থেকে মেশিন বহন করে নিয়ে জমিতে যেতে হতো। কখনো কখনো তেলের জন্য বাজারে যেতে হতো। আর ঘনঘন লোডশেডিং তো নিত্য বিড়ম্বনা ছিলো। কিন্তু সৌরবিদ্যুৎ সুবিধায় এখন সেচ কাজের কোন সমস্যা নেই। সবকিছুই সাশ্রয় হয়েছে।’
’অন্যদিকে কাউনিয়ার কুর্শা ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর এলাকার কৃষক মানিক মিয়া ও রাশেদুল ইসলাম বার্তা২৪.কম-কে জানান, ‘সৌরবিদ্যুতের কারণে এখন সেচের পানি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। যখন ইচ্ছে সেচ কাজ করা যায়। তিন চার বছর আগে রাত জেগে সেচ দিতে হতো। এখন সৌরবিদ্যুতের বদৌলতে খরচও কমেছে, কষ্টও নেই।’
এদিকে কৃষক নেতা পলাশ কান্তি নাগ বার্তা২৪.কম-কে জানান, ‘সরকারের বিভিন্ন সফল উদ্যোগের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ একটি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলের কৃষকরা এখন সেচ কাজে সৌর বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকছেন। এজন্য সরকারকে কৃষকদের বাঁচাতে এর ব্যয় কমাতে হবে।’
বিভিন্ন সোলার প্ল্যান্ট সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, অর্ধেক ভর্তুকিসহ সৌর বিদ্যুৎচালিত ১৫ কিলোওয়াটের একটি সেচ পাম্প স্থাপনে ব্যয় হয় ৪৫ লাখ টাকা। আর ১৮ কিলোওয়াটের জন্য লাগে ৫২ লাখ টাকা। বর্তমানে রংপুর বিভাগের আট জেলায় প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার একর জমিতে সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচ ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড- ইডকলের আওতায় রয়েছে সাত হাজার একর জমি।
ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড- ইডকলের তথ্য মতে, রংপুর বিভাগের আট জেলার ৭০ হাজার পাঁচশ শতক জমি সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্পের আওতায় রয়েছে। এতে প্রায় ৬৫ হাজার কৃষক সেচ সুবিধা পাচ্ছেন। এর বাইরেও অনেক কৃষক নিজ উদ্যোগে ও বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচ সুবিধা নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে ইডকলের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিভাগীয় ব্যবস্থাপক সেলিম রেজা বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে দেশের ১০টি জেলায় ইডকল সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্টের মাধ্যমে কৃষকদের সেচ সুবিধা দিচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্ল্যান্ট রয়েছে রংপুর জেলায় রয়েছে। এ বিভাগের মধ্যে রংপুরে ৩১৫টি, দিনাজপুর ২০০টি, পঞ্চগড়ে ১৫০ এবং ঠাকুরগাঁওয়ে ৪০টি সৌর বিদ্যুৎচালিত সেচ প্ল্যান্ট রয়েছে। এসব প্ল্যান্ট থেকে গড়ে ৬৫ হাজার কৃষক সুবিধা পাচ্ছেন। এছাড়াও অন্যান্য জেলাতেও প্ল্যান্ট স্থাপন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সৌর বিদ্যুতের কারণে প্রতি বছর সাত হাজার চারশ ২ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে। যার মূল্য প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, রংপুর বিভাগে ইডকল স্থাপিত পরিবেশবান্ধব সাতশ পাঁচটি সেচ পাম্প থেকে প্রতি বছর সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় একত্রিশ লাখ লিটার ডিজেল। যার বাজার মূল্য প্রায় ২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা।’
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘একেকটি সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট থেকে গড়ে আশি-নব্বই জন কৃষক সেচ সুবিধা পাচ্ছেন। কৃষকদের সেচ সুবিধা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারি ভর্তুকিসহ ঋণ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ইলেকট্রিক পাম্প স্থাপনে খরচ অনেক হলেও আমরা তা কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছি।’
অতিরিক্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে। তবে সরকার যদি এখানে বেশি পরিমাণ ভর্তুকি দেয়, তাহলে কৃষকের সেচের খরচ কমে আসবে। এছাড়া উৎপাদনও ভাল হবে।’