রোগ প্রতিরোধে প্রমাণিত পদ্ধতি ফিজিওথেরাপি
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রধান প্রবণতা ওষুধের সাহায্যে ও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রোগ সারানোর চেষ্টা করা। কিন্তু জনস্বাস্থ্যসেবা বলতে তো শুধু একমাত্র চিকিৎসাকেই বোঝায় না। যদিও এই ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্যের জন্য রোগ প্রতিরোধ এর বিষয়ও যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এতদিন অবহেলিত হলেও বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এখন কিন্তু খুব সহজেই বুঝতে পারছি । করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও সংক্রমণ পরবর্তী অবস্থা থেক পরিত্রাণ পেতে বর্তমানে সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য সতর্কতা বজায় রাখার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ বাড়ানোর বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে ।
চলমান ব্যস্ততম দিনপঞ্জিকে ঠেলে দিয়ে করোনাভাইরাস এর সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকতে আমরা এখন ঘরবন্দী। এই পরিস্থিতিতে ঘরের বাহিরের ফিজিক্যাল এক্টিভিটি একেবারে নাই বললেই চলে। ঘরে অবস্থানকালীন সময়ে নিজেকে কখনও কখনও নিষ্ক্রিয়, উদ্বিগ্ন, অসহায় ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হতে পারে। ফলে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বিঘ্নিত হতে পারে । এর মধ্যে যারা আগে থেকে বিভিন্ন রকম বাত ব্যথা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হাঁপানিসহ অন্যান্য রোগ ও সমস্যায় ভুগছেন, সেগুলোর প্রকোপও বেড়ে যেতে পারে । এই রকম পরিস্থিতিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখা বা বৃদ্ধিকরণে এবং শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে এবং সর্বোপরি সুস্থতার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস এর সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্দেশিত ফিজিওথেরাপি (এক্সারসাইজ গুলো ) নিয়মিত বাসায় করতে হবে।
এমনকি শত বছর ধরে সকল ধরনের স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা রোগ প্রতিরোধ, প্রতিকার ও স্বাভাবিক সুস্থতার জন্য নিয়মিত এক্সারসাইজ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন । তাই রোগ প্রতিরোধে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এক্সারসাইজকে বলা হয় বেস্ট মেডিসিন । এক্সারসাইজকে যেহেতু মেডিসিন বলা হয়, তাই অন্যান্য মেডিসিনের মতো এক্সারসাইজ এর প্রেসক্রিপশন নীতিমালাও আছে । তাই এক্সারসাইজ এর সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে যথাযথভাবে এর রুলস মানতে হবে, না হয় হিতে বিপরীতও হতে পারে । এই বিষয়ে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকরাই প্রধান স্বাস্থ্য পেশাজীবী । বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি সম্পর্কে জানা শোনার বিরাট ঘাটতি আছে। রোগ বা সমস্যার প্রতিরোধ, প্রতিকারে মেডিকেল সায়েন্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হিসেবে ফিজিওথেরাপি এখন বিশ্বব্যাপী ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফিজিওথেরাপি এমন এক বিদ্যা বা আর্ট অব সায়েন্স, যার প্রধান প্রবণতা ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি আর থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ এর মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ও রোগ সারানো এবং সুস্থ ও সচল জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে দেওয়া। ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি ও ফিজিক্যাল এক্সারসাইজকে সব বয়সের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তোলার কাজে সহযোগিতা করতে পারেন একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক ।
পুঁজিবাদী দুনিয়ার চিকিৎসাসেবা নামের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ফিজিওথেরাপির বিরোধ আছে । চিকিৎসা যখন ব্যবসা, তখন রোগের প্রতিরোধ নিয়ে কিংবা মানুষের স্বাস্থ্যকর জীবনাভ্যাস গড়ার বিষয়ে অনীহা লক্ষ্যণীয় । আর একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগ প্রতিরোধ নিয়েই তাঁর প্রধান কাজ, যাতে মানুষ শারীরিক পরিশ্রম বা সক্রিয়তা আর নিয়মিত এক্সারসাইজ করে সুস্থ থাকে। এ রকম পরিস্থিতিতে ফিজিওথেরাপির ব্যাপক প্রসার খুব জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে এই বিদ্যা এখনো বেশ অবহেলিত।
আমরা অবহেলিত হলেও দেশের মানুষ থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ শুরু করার আগে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে শুরু করতে পারেন অথবা নিন্মোক্ত এক্সারসাইজগুলো বাসায় অনুশীলন করতে পারেন ।
১। বসে বা শুয়ে ১০ মিনিট করে দিনে ২ বার ডিপ ব্রিথিং ( লম্বা নিঃশ্বাস নিন এবং সম্পূর্ণ নিঃশ্বাস ছাড়ুন ) ।
২। যে যেভাবে পারেন বাসার ভেতর সময় নিয়ে প্রতিদিন হাঁটুন, স্ট্যাটিক সাইকেল থাকলে সাইক্লিং করুন- সময় অন্তত ৪০-৬০ মিনিট ।
৩। বাসার কাজ যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ অন্যান্য কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে এক্সারসাইজ এর একটি বড় অংশ হয়ে যাবে ।
৪। হাত, পা, মেরুদণ্ডের ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ যেমন উঠাবসা করা, হাত উপর নিচ করা ও পাশে উঠানো, হাত পাকে চারদিকে ঘোরানো, পা দিয়ে লাথি মারা, লেগ প্রেস করা, হাত দিয়ে বক্সিং মারা, শুয়ে পা দিয়ে সাইক্লিং করা, লাঞ্জিং করা, স্কয়াট, ব্রিজিং এক্সারসাইজ সহ অন্যান্য এক্সারসাইজ ১০ বার করে দিনে ২ বার করতে পারেন ।
৫। ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ এর পরে কয়েক মিনিট কিছু ডাইনামিক ও স্টেটিক স্ট্রেচিং করুন ।
৬। সবশেষে অন্তত ৭ মিনিট শব্দ করে হাসুন ।
উল্লেখ্য, কোন এক্সারসাইজ করার সময় অসুবিধা বোধ করলে সেই এক্সারসাইজ করবেন না । প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন ।
ডা. দলিলুর রহমান, সিনিয়র কনসালটেন্ট, কেয়ার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ।
সভাপতি, বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি এসোসিয়েশন (বিপিএ)
ই-মেইল- [email protected]