যেভাবে রায়ের মুখ দেখেছিল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৭১ পৃষ্ঠার রায়ে তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুলের আদালত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ১৮ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বাকিদের খালাসের রায় দেন তিনি।
নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেন। বিচারপতি এম রুহুল আমিন ৫ আসামিকে খালাস দিয়ে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন। অপরদিকে বিচারপতি এবিএম খায়রুর হক ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন।
বিভক্ত রায় হওয়ায় নিয়মানুযায়ী একটি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ৩ জনকে খালাস দেন তিনি।
মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামি হলেন— সাবেক মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক রহমান, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব.) নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান, লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ ও লে. কর্নেল আজিজ পাশা (অব.)।
তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার নথিতে মৃত্যু সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত না থাকায় লে. কর্নেল আব্দুল আজিজ পাশাকেও পলাতক দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী আসামি আজিজ পাশা ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১২ আসামির মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। তারা হলেন— সাবেক মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক রহমান, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি)। তাদের মধ্যে বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড ও মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকরা। সেদিন ঘাতকদের নির্মম বুলেট প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সহধর্মিনী ফজিলাতুন নেসা, ৩ ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, ২ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি কামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান, পেট্রোল ডিউটির সৈনিক সামছুল হক ও রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলের।
ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসা তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ জারি করে এ বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেন। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করে হত্যাকাণ্ডটির বিচারের পথ সুগম করে।
১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর বাড়িটির রিসিপশনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে ঢাকার ধানমণ্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর ১০(১০)৯৬)।
ঘটনাটি তদন্ত করে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। পুলিশি তদন্তে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ আরও চারজনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও চার্জশিট দাখিলের আগেই তারা মৃত্যুবরণ করায় চার্জশিটে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যাওয়া ফারুক-রশিদ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ১৯৭৬ সালে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দেন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ধারণকৃত ওই ভিডিওসহ ৪৬ ধরনের আলামত চার্জশিটের সঙ্গে আদালতে জমা দেওয়া হয়। সাক্ষী করা হয় ৭৪ জনকে।
মামলাটির বিচার শুরু হলে ২০২ কার্যদিবসে ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। মামলাটির প্রধান স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করেন বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা মো. সিরাজুল হক। আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খান সাইফুর রহমান, আব্দুর রেজ্জাক খান, টিএম আকবর প্রমুখ।