ইলিশের দেখা নেই, জেলেদের ঈদের আনন্দ ম্লান
করোনার ক্রান্তিলগ্নে রমজান এসেছিল। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাসটি শেষও হয়ে যাচ্ছে। সোমবার (২৫ মে) দেশজুড়ে পালিত হবে পবিত্র ঈদুল ফিতর।
করোনার ডর-ভয়, বিধি-নিষেধ ও শর্তের বেড়াজালে কিছু মানুষ ঈদের কেনাকাটা করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মানুষ বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াতও করেছে। কিন্তু মেঘনা উপকূলের দরিদ্র মানুষগুলো পারেনি কেনাকাটা করতে। তাদের মনে আসেনি, ঈদ এসে গেছে! নতুন জামা-কাপড় কিনতে হবে নিজের জন্য কিংবা পরিবারের সদস্যদের জন্য। তাদের একটাই চিন্তা, নদীতে মাছ ধরবে আর বিক্রি করে খাবারের চাল কিনবে। কারণ তাদের কাছে ঈদের চেয়ে পেট পুরে খাবার জোগানই বড় আনন্দের। কিন্তু নদীতে পর্যাপ্ত ইলিশ না পাওয়ায় ঈদেও ওদের আকাশটা ঘোলাটে, বিবর্ণ।
মার্চ-এপ্রিল দুই মাস লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার থেকে চাঁদপুরের ষাটনল পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত মেঘনা নদী এলাকায় সকল প্রজাতির মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। সরকারি নির্দেশ মান্য করে প্রায় ৯৫ শতাংশ জেলেই নামেনি নদীতে। বাকি জেলেরা গোপনে নদীতে নেমে মাছ শিকার করেছে। এদের মধ্যে অনেককেই প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ে জরিমানা দিয়েছে, অনেকের ঠাঁই হয়েছে কারাগারে।
নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ শিকার বন্ধ থাকায় সরকার থেকে লক্ষ্মীপুরের প্রায় ২৪ হাজার জেলেকে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। যদিও জেলায় সরকারি হিসেবে প্রায় ৫২ হাজার জেলে রয়েছেন। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে প্রায় ৬২ হাজার জেলে মেঘনা নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারি সুবিধা পান অর্ধেকেরও কম জেলে। এতে সংসার খরচ, দাদনদার ও ধারদেনা পরিশোধ করার চিন্তা নিয়েই ঝুঁকি নিয়ে নদীতে গিয়ে জেল জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। সঙ্গে লাখ লাখ টাকার জাল ও নৌকাও হারাতে হয় তাদের।
ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে নদীতে কারেন্ট জাল ব্যবহার করা সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবুও ব্যবহার বন্ধ করছে না জেলেরা। প্রশাসনের বিভিন্ন অভিযানে বেহুন্দি ও কারেন্ট জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। কিন্তু জেলেরা ধারদেনা ও দাদনদারের কাছে সুদে টাকা নিয়ে জালগুলো কেনে। পুড়ে ফেললে পুরোটাই ক্ষতি জেলের। প্রশাসন কিংবা সচেতন মহল কেউই বিষয়টি চিন্তা করে না।
জেলেদের দাবি, তারা বাজারে কারেন্ট জাল পায় বলেই কেনে। যদি এটি উৎপাদন বন্ধ হতো, তাহলে তারাও কিনতে পারতো না। উৎপাদককে কেউই শাস্তি দিচ্ছে না। যত শাস্তি গরিব জেলেদের। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। জালে মাছ না উঠলে খাবার জোটে না।
এসেছে ঈদুল ফিতর। তবে জেলে পল্লীর জন্য নয়। সমাজের বিত্তবানদের জন্য; না হয় উপকূল থেকে দূরে বসবাসকারীদের জন্য। জেলে পল্লীর প্রধান ঈদ হচ্ছে- পেট পুরে খেতে পারা। ছেলেমেয়েদের পাতে এক টুকরো মুরগির মাংস তুলে দেওয়া। কিন্তু এটাই তাদের জন্য খুব কষ্টসাধ্য। মার্চ-এপ্রিল দুই মাস পর মে মাসের প্রথম দিন তারা নদীতে নেমেছিল। দুই মাস পর আনন্দ-উৎসব নিয়ে নদীতে গেলেও মেলেনি কাঙ্খিত ইলিশ। কোনোরকম নৌকার তেল খরচ ও জেলেদের হাত খরচ জোগানো সম্ভব হলেও চাল-ডাল-তেল-নুন কিনতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেখানে ছেলেমেয়েদের জন্য ঈদের জামা কিনবে কোথা থেকে?
করোনাকালে সরকার, রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিগতভাবে অনেকে প্রচুর ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন। সেসব থেকেও জেলে পরিবারগুলো বেশি বঞ্চিত। জেলার মজুচৌধুরীর হাট, হাজিমারা, লুধুয়া, মতিরহাট, বাত্তিরখাল, আলেকজান্ডারসহ পুরো উপকূলেই একই অবস্থা।
কমলনগর উপজেলার বাত্তিরখাল এলাকার জেলে ওসমান গণি, মোহাম্মদ হোসেন ও চিংড়ি রেনু আহরণকারী আনোয়ার হোসেন জানায়, সারাদিন যে কয়টা মাছ পায়, ধারদেনা পরিশোধ করেই সব শেষ হয়ে যায়। সংসার খরচ কোনো রকম চলে। তারা কেউই নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি খাদ্য সহায়তা পায়নি। তবে তাদের ছিল জেলে কার্ড। এরকম অসংখ্য জেলে রয়েছে, যারা স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নিয়ে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করে।
আসলে মেঘ না থাকলেও, মেঘনায় ইলিশ না মেলা পর্যন্ত জেলেদের জন্য আকাশটা অন্ধকার থাকে। সূর্যের আলো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও সেই অন্ধকার ছাড়াতে পারে না। একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাতেই তাদের আকাশটা আলোয় পরিণত হয়। তবে করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের এই ক্রান্তিলগ্নে পাওয়া ঈদটিতে জেলেদের আকাশ রয়েছে ঘোলাটে অবস্থায়। প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, ব্যক্তিগত উদ্যোগের ত্রাণ কিছুই পৌঁছায় না তাদের কাছ পর্যন্ত। যদি পৌঁছাতো, কিছুটা হলেও মেঘ সরে আলোর দেখা মিলতো জেলে পল্লীতে।