জঙ্গিবিরোধী অভিযানে র্যাবের সাফল্য, কোনঠাসা জেএমবি
২০০৬ সালের ২ মার্চ। সিলেটের টিলাগড় এলাকার ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র দিকে মনোযোগ দেশবাসীর। চাপা উত্তেজনা, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার পাশাপাশি নানাবিধ জল্পনা। কী হবে শেষ পর্যন্ত? বাড়িটি ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ঘেরাও করে রেখেছে র্যাব সদস্যরা। এখানে সপরিবারে আছেন জঙ্গি সংগঠন জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আব্দুর রহমান।
এর প্রায় মাস ছয়েক আগে একযোগে বাংলাদেশের ৬৩ জেলার ৫শ’ স্থানে বোমা হামলা চালায় জেএমবি। সুতরাং আলোচনা আর মনোযোগ ওই বাড়ির দিকে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
টান টান উত্তেজনা আর নানা নাটকীয়তা শেষে ৩ দিন পর অক্ষত অবস্থায় ওই বাড়ি থেকে শায়খ আব্দুর রহমানকে বের করে আনা হয়। পরে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ফাঁসিতে ঝুলতে হয় তাকে।
এরপর জঙ্গি সংগঠন জেএমবির নেতৃত্ব পান ডা. নজরুল ইসলাম। ততদিনে জেএমবি দুই গ্রুপে বিভক্ত। কারাবন্দি মাওলানা সাঈদুর রহমানের গ্রুপকে জেএমবি ভেতরের গ্রুপ আর আবদুর রহমান ওরফে সারওয়ার জাহান মানিক ও ডা. নজরুল ইসলামের গ্রুপকে বাইরের গ্রুপ বলে মনে করা হয়। পরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ডা. নজরুলকে হত্যা করা অথবা গুম করে দেওয়া হয়। তার আর কোনো হদিস মেলেনি।
এরপর নতুন জেএমবির আমিরের দায়িত্ব পায় আবু ইউসুফ। পরে তাকে সরিয়ে সারওয়ার জাহানকে যখন আমির বানানো হয়, তখন শুরা সদস্য ছিলো- রাইসুল ইসলাম খান ওরফে ফারদিন, মামুনুর রশিদ রিপন, নুরুল ইসলাম মারজান ও শফিক। সারওয়ার জাহান যখন আমির ছিলেন তখন তামিম চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক হয়। এই তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে বা পরিকল্পনায় দেশে আলোচিত হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলার ঘটনা ঘটে।
৮ অক্টোবর ২০১৬। আশুলিয়ায় র্যাবের অভিযানে বিভক্ত জেএমবির প্রধান সারোয়ার জাহান পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়।
শুরু থেকেই জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা এবং বিভক্ত জেএমবির হাল ধরে টিকে থাকতে চাওয়া জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল র্যাব। এ যুদ্ধে একে একে সাফল্যও পেতে থাকে বাহিনীটি।
মাঝের এই বছরগুলোতে বাংলাদেশে কথিত খেলাফত কায়েমের লক্ষ্যে ও জনমনে আতঙ্ক তৈরি এবং হামলা করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসএর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল সংগঠন অন্য নেতারা। এ পরিকল্পনাতেও র্যাব বাগড়া দিয়ে তাদের নিঃশেষ করতে কাজ করেছে এখনও করছে।
র্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আলোকে জঙ্গি দমনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে। র্যাব সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ২ হাজার ১৮৯ জন সদস্যকে তারা আটক করেছে।
৪ বছর আগে ২০১৬ গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে নারকীয় জঙ্গি হামলা চালিয়ে আবারও নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চায় জঙ্গিরা। তাতেও তারা সফল হয়নি।
ওই ঘটনায় জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে পরবর্তীতে র্যাব জঙ্গিদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের আটক করতে সক্রিয় হয়। জঙ্গি সংগঠনের আমিরসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সাফল্য অর্জন করে। র্যাবের অভিযানে কেন্দ্রীয় দাওয়াতি শাখা প্রধান, শুরা ও শরিয়া বোর্ড সদস্য, মহিলা শাখার নেতৃবৃন্দ এবং বেশ কয়েকজন অতি গুরুত্বপূর্ণ আইটি বিশেষজ্ঞকে আটকের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনকে দুর্বল করে দেয়।
ফোর্সটি বলছে, হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলার পর থেকে সময়োচিত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও তীক্ষ্ম গোয়েন্দা নজরদারির ফলে মোট ৩৯৫টি অভিযান পরিচালিত হয়। ১৭টি জঙ্গি আস্তানায় সফল অভিযানের পাশাপাশি ১ হাজার ১৬ জন জঙ্গি আটক, ৭ জন আত্মসর্মপণ এবং ২৫ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। উদ্ধার করা হয় ৮৫টি গ্রেনেড, ৭১টি ডেটোনেটর ও ৫৮টি দেশি-বিদেশি অস্ত্র।
জানতে চাইলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদ্য দায়িত্ব পাওয়া গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বার্তা২৪.কমকে বলেন, র্যাব শুরু থেকেই জঙ্গি নিয়ে কাজ করছে। যখন যেখানে জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে, র্যাব তাদের দমন ও নির্মূলে কাজ করেছে।
শুধু অভিযানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি র্যাব। জঙ্গিবিরোধী প্রতিরোধমূলক বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। জঙ্গিবিরোধী প্রচার-প্রচারণা, সমাবেশ, বিলবোর্ড, স্টিকার বিতরণ এবং জঙ্গি দমনে বই-পুস্তক প্রকাশ করেছে তারা। তাছাড়া জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসন নিয়েও কাজ করেছে র্যাব। যেটা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল বার্তা২৪.কমকে বলেন, জঙ্গি দমনে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে র্যাব। আমরা জঙ্গি নির্মূলে চারটি জেনারেশনে জঙ্গিদেরকে ভাগ করেছি। প্রথম জেনারেশন অর্থাৎ ১৯৯০ সালের হরকতুল জিহাদ আল ইসলাম বাংলাদেশ (হুজিবি), দ্বিতীয় জেনারেশন ১৯৯৫ সালের জেএমবি, তৃতীয় জেনারেশন ২০০০ সালের হিজবুত তাওহিদ এবং চতুর্থ জেনারেশন বিভক্ত জেএমবি।
এসব নানা তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে জঙ্গি দমনে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে র্যাব এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। যেমন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও অপারেশন পরিচালনা করা। জঙ্গি দমনে জনগণের সম্পৃক্ততা। ক্রমাগত নিজস্ব গোয়েন্দা ও অপারেশন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্তি প্রতিহত করা। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।