ঘর থেকে পা বাড়ালেই মেঘনার ভাঙন
‘দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপরে, একটি শিশির বিন্দু’ কবিতার এই লাইনগুলোর মর্মার্থ বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমে ঘর থেকে বের হতে হবে। কিন্তু লক্ষ্মীপুরে ভাঙন কবলিত মেঘনার পাড়ের মানুষগুলোর পক্ষে সেটি সম্ভব নয়। কারণ ঘর থেকে পা বাড়ালেই দেখা মেলে মেঘনার ভাঙন। কোথাও কোথাও ঘর থেকে পা দিলেই নদীতে পড়ে। তাদের তো ভবিষ্যতই অন্ধকার। তারা কিভাবে দেখবে ধানের শীষে শিশির বিন্দু?
করোনাভাইরাসের ক্রান্তিলগ্নে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায় চরম দুর্দিনে রয়েছে ভাঙন কবলিত মেঘনা উপকূলের মানুষগুলো। প্রায় তিন যুগ ধরে অব্যাহত ভাঙনে আজ অনেকই নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। যারা এখনো নদীর পাড়ে বসবাস করছেন, তারা প্রতিনিয়তই নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। তাদের এই দুর্দিনে কেউই তাদের পাশে নেই।
ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে এই উপকূলবাসীর ঠিকানা কোথায় হবে? সেটি শুধু অজানায় থেকে যায়। অনেকে হয়তো লক্ষ্মীপুর-রামগতিসহ বিভিন্ন সড়কের পাশে বসতি স্থাপন করছেন। আবার অনেকে অন্যদের জমিতে কোনরকম মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিচ্ছেন। তাতেও নিরাপত্তা নেই তাদের। যেকোনো সময় তাদেরকে স্থান চ্যুত হতে হবে। অনিশ্চয়তায় রয়েছে তাদের ভবিষ্যৎ।
কমলনগর উপজেলার চরকালকিনি ইউনিয়নের নাছিরগঞ্জ এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর তীব্র ভাঙনে নাছিরগঞ্জ বাজারের অর্ধেকেরও বেশি বিলীন হয়ে গেছে। বাকি অংশটুকু রক্ষায় স্থানীয় যুবকদের উদ্যোগে জঙ্গলাবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু মেঘনার ঢেউয়ের সঙ্গে বার বার বাঁধটি বিধ্বস্ত হচ্ছে। আর প্রত্যেকবারই সেটি পুনরায় ঠিক করা হচ্ছে।
নদীতে ভাটা চলাকালীন জেগে ওঠা বেলাভূমি ধরে বাজার থেকে ১০০ গজ দক্ষিণে গেলে দেখা মেলে তিনটি ঘর। ভয়ংকর মেঘনায় ভেসে আসা কলাগাছসহ বিভিন্ন আগাছা সেই ঘরগুলোর চৌকাঠে গিয়ে ঠেকেছে। দুটি ঘরে ঘরের চাল নেই, বেড়া নেই শুধু ভিটের ওপরেই বসে থাকতে দেখা যায় কয়েকজন শিশুকে। পাশেই ছোট ঝুপড়ির মতো একটি ঘরে রান্না করছিলেন জেলে আমির হোসেনের স্ত্রী। এ সময় তার নাম জানতে চাইলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তবে নাম বলতে রাজি হননি। তার দাবি নাম বললে কোনো উপকার হবে না, তাই বলবেন না।
আমির হোসেনের স্ত্রী জানান, ৩ বার ভেঙেছে তাদের ঘরবাড়ি। এই ভাঙনে তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন। ঘরের আসবাবপত্র পার্শ্ববর্তী রাস্তায় রেখে এসেছে। রান্নার জন্য ভাঙন কবলিত ভিটায় আসতে হয়েছে। রান্না ঘরের আসবাবপত্রও নিয়ে যাবেন তারা। তবে কোথায় যাবেন সেটি জানেন না। পার্শ্ববর্তী একটি ঘরে কোনমতে রাত কাটান তারা। বাকি সময় খোলা আকাশের নিচেই কাটে তাদের।
আমিরের ছেলে রাকিব হোসেন জানান, সে বাবার সঙ্গে নৌকায় মাছ ধরতে যায়। ঘরের আসবাবপত্র সরানোর জন্য সে নদীতে যায়নি। কিন্তু এখন তাদের বসতি কোথায় হবে তা সে জানে না। তার বাবা আসলে সিদ্ধান্ত নেবে।
মেঘনা উপকূলের মানুষগুলো ভাঙনের কারণে আজ অসহায় হয়ে পড়েছেন। এক সময় যাদের কয়েক একর জমি ছিল, কিন্তু এখন থাকার জন্য এক শতাংশ জমিও নেই তাদের। অন্যের দয়ায় নিজেদেরকে চালিয়ে নিতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সদর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলার মেঘনা নদীর ৩২ কিলোমিটার এলাকা ভাঙন কবলিত। এরমধ্যে কমলনগরে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা না গেলে কমলনগর উপজেলাটি অর্ধেকেরও বেশি মেঘনায় বিলীন হয়ে যাবে। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি বহু স্থাপনা তলিয়ে যাবে মেঘনায়। ভাঙন থেকে রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই অঞ্চলের মানুষের দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা।