অনিয়মই নিয়ম বেফাকে, মানা হয় না গঠনতন্ত্র!
অনিয়মই যেনো বেফাকের নিয়মে পরিণত হয়েছে। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ বেফাকের কার্যক্রম পরিচালনায় মানা হয় না গঠনতন্ত্র। তবে ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার নজির রয়েছে ভুরি ভুরি। গঠনতন্ত্রে বেফাকের মজলিসে আমেলার (নির্বাহী কমিটি) সদস্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ১২১ জন পর্যন্ত হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে কমিটির ব্যপ্তি ১৫৫ জনের। অভিযোগ রয়েছে, নেতৃস্থানীয়রা তাদের প্রভাববলয় বিস্তারের জন্য কমিটিতে চেনা-জানাদের জায়গা করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে কমিটি গঠনে এলাকাপ্রীতি, স্বজনতোষণ এবং রাজনৈতিক নেতাদের জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি বেফাক প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছর পর্যন্ত বেফাকের কর্মনীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আসা এবং বেফাকে নিজ নিজ মাদরাসা অন্তর্ভুক্তি না করানো প্রিন্সিপালরা বেফাকে যোগ দিয়েই পেয়েছেন সহ-সভাপতি, সহকারী মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। বেফাকের সংবিধান উপেক্ষা করে মজলিসে শুরা ও আমেলার মতামত না নিয়ে গঠন করা হয় মজলিসে খাস। এটা নিয়ে আলেমসমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ায় গঠনতন্ত্র সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বেফাকে মাওলানা আনাসের প্রভাব
বেফাক সূত্রে জানা গেছে, আল্লামা আহমদ শফী দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত কারণে স্বাভাবিক চলাফেরা ও প্রশাসনিক কাজ তদারকি করতে পারছেন না। ফলে দাফতরিক কাজের জন্য তার ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীর ওপর নির্ভর করতে হয়। এই সুযোগে বেফাকে নিজের প্রভাব বলয় বাড়াতে শুরু করেন তিনি। বিভিন্ন মিটিংয়ে আল্লামা শফীর পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে ওই চিঠির আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করেন তিনি। এসব চিঠির সত্যতা নিয়ে খোদ বেফাকের কর্মকর্তাও সন্দিহান। তার পরও কেউ এসবের প্রতিবাদ করেন না। অনেক আমেলার সদস্য মিটিংয়ে যান না শুধু এ কারণে যে, মিটিংয়ে যেয়ে কী হবে, সিদ্ধান্ত তো হবে চিঠির আলোকে।
আরও পড়ুন: কওমি অঙ্গনে ক্ষোভ দানা বাঁধছে ধীরে ধীরে
গঠনতন্ত্রে বলা আছে, ‘বেফাকের অন্তর্ভূক্ত সকল কওমী মাদরাসার মুহতামিম পদাধিকার বলে অত্র সংস্থার সাধারণ সদস্য বলে গণ্য হবেন।’ কিন্তু বেফাকের সভাপতি আল্লামা শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানী সহ-সভাপতির পদে আছেন। বয়োজেষ্ঠ না হয়েও মাওলানা আনাস মাদানী শুধু আল্লামা শফীর ছেলে হওয়ায় এই পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি হাটহাজারী মাদরাসার সহকারী শিক্ষা পরিচালক। একই মাদরাসার শিক্ষক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীও বেফাকের সহ-সভাপতি। এক মাদরাসা থেকে এভাবে তিনজনের অন্তর্ভুক্তি স্পষ্ট গঠনতন্ত্রের সঙ্গে অসামঞ্জসাপূর্ণ। তবে, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে সর্বশেষ কাউন্সিলে সহ-সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে এক নম্বর নির্বাহী সদস্য করা হয়। আর সহ-সভাপতি হন মাওলানা আনাস। পরে অবশ্য নানামুখী চাপের কারণে আল্লামা বাবুনগরীেক সহ-সভাপতি করা হয়।
অন্যদিকে ফরিবাদবাদ মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা নুরুল আমিন বেফাকের সহকারী মহাসচিব পদে অধিষ্ঠিত। ওই মাদরাসার প্রিন্সিপাল আবদুল কুদ্দস বেফাকের মহাসচিব। মাওলানা নুরুল আমিন বেফাক মহাসচিবের ভগ্নিপতি। এভাবে লালবাগ মাদরাসার প্রিন্সিপাল না হয়ে শুধু চট্টগ্রামে বাড়ি ও আল্লামা শফীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাধে মুফতি ফয়জুল্লাহ বেফাকের সহ-সভাপতি পদে আসীন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আলেম বলছেন, ‘দ্বীনি শিক্ষায় স্বজনপ্রীতির বিরোধিতা করা হলেও এ ধরনের চর্চা দেশের সবচেয়ে বড় কওমি প্রতিষ্ঠানটিকে সঠিকভাবে পরিচালিত হতে বাধাগ্রস্ত করছে। এর অবসান দরকার।’
দেশের বৃহৎ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)-এর দশম কাউন্সিলে তারা কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। আগের কমিটির তুলনায় কলেবরে বাড়ানো হয় নতুন কমিটির। এখানে গঠনতন্ত্র মানা হয়নি। এগুলো নিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আলেমরা প্রতিবাদ জানালেও কোনো প্রতিকার হয়নি। শুধু কয়েকজনকে পদায়ন করে ক্ষোভ উপশম করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দাবি অনুযায়ী বেফাকে কোনো সংস্কার হয়নি। এটা নিয়ে আলেমরা অসন্তুষ্ট।
বেফাকের কমিটি
২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে বেফাকের পুনরায় সভাপতি হন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী। গত ১৫ বছর ধরে এই পদে আছেন তিনি। ১৯৭৮ সালে বেফাক প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বেফাকের সভাপতি ছিলেন- মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুস রহ.। এরপর মাওলানা মুহাম্মদ হারুন ইসলামাবাদী (১৯৯২-৯৬), মাওলানা নুরুদ্দীন আহমাদ গহরপুরী (১৯৯৬-২০০৫) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সাল থেকে আল্লামা শাহ আহমাদ শফী বেফাকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, তখনও হাটহাজারী মাদরাসা বেফাকের আওতাভুক্ত হয়নি। এমনকি এখনও বেফাকের কেন্দ্রীয় সব পরীক্ষায় হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররা অংশ নেন না। এটা নিয়েও ক্ষোভে রয়েছে। এর বিরোধীতা করায় বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফ মাওলানা আনাস মাদানীকে বলে খাস কমিটি বিপুলপ্তির জন্য প্রলুব্ধ করছেন। ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপে বিষয়টি প্রমাণিত।
দশম কাউন্সিলের পর ঘোষিত নির্বাহী কমিটিতে সহ-সভাপতি রয়েছেন প্রায় ত্রিশ জন। মহাসচিবের দায়িত্ব পান জামিয়া ইমদাদিয়া ফরিবাদাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আবদুল কুদ্দুস। ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর বেফাকের পুরনো কমিটির মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদীর মৃত্যুর পর থেকেই বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। এর আগে সংস্থাটির মহাসচিব ছিলেন- শায়খুল হাদিস আল্লামা আজীজুল হক রহ. (১৯৭৮-৮২), মাওলানা আতাউর রহমান খাঁন রহ. (১৯৮৩-৯১) ও মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার রহ. (১৯৯২-২০১৬)। মাঝে ২০০৫ সালে মুফতি রুহুল আমীন ছয় মাস মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। সহকারী মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন আটজন। সহকারী মহাসচিব নিয়োগেও নিয়ম মানা হয়নি। একই মাদরাসা থেকে সদস্য করা ছাড়াও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আল্লামা শফীর অনুসারীদের। এটা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে আলেমদের মাঝে।
আলেমদের আশা-আকাঙ্খার বেফাক
১৯৭৮ সালের এক উলামা সম্মেলনে গঠিত হয় বাংলাদেশ কওমি শিক্ষা বোর্ড বেফাক। ২৬ বছর পর ২০০৬ সালে নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য ভূমি ক্রয় করে বোর্ড। কিন্তু এখনও নিজস্ব জায়গায় পরিকল্পিত কোনো ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। দেশের অন্যতম বৃহৎ দ্বীনি শিক্ষাবোর্ডের কার্যক্রম চলছে জীর্ণ আধাপাকা ভবনে।
প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার এমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসায় স্থাপন করা হয় বেফাকের অস্থায়ী কার্যালয়। এরপর তা স্থানান্তরিত হয় ঢাকার নয়া পল্টনে একটি ভাড়া বাড়িতে।এ দুই জায়গায় আড়াই দশক পার করে যাত্রাবাড়ীর কাজলায় নিজস্ব ভূমিতে পা রাখে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।
বহু চেষ্টার পর বেফাকের নিজের হয় মূল্যবান ২৭ শতাংশ জমি। বেফাকের সাবেক সভাপতি আল্লামা নূরুদ্দীন গহরপুরী রহ. নিজে এ জমি বায়না করেন এবং কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে পরিশোধ করা হয় তার মূল্য। নিজস্ব ভূমিতে স্থায়ী ও পরিকল্পিত বহুতল ভবনের জন্য রাজউকের অনুমোদন মিলেছে ২০১৮ সালের শেষভাগে। বেফাকের ইচ্ছা, ২৭ শতাংশ জমির ওপর দুটি বহুতল ভবন করার। দুটি ভবনই হবে ১০তলা বিশিষ্ট। এসব ভবনে থাকবে- মসজিদ, বিষয়ভিত্তিক টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার, পাঠাগার, গবেষণাগার, অডিটোরিয়াম, বিশ্রামাগার, প্রত্যেক বিভাগের ভিন্ন ভিন্ন অফিস, বেফাকের স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রকশনা প্রতিষ্ঠান এবং বই বিক্রয় কেন্দ্র।
আগামী পর্বে: আগের অভিযোগের সুরাহাও হয়নি