জনককে জানার সেরা কিছু বই



আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিল; কেউ কি জানত তার মুখের কথায় একদিন কেঁপে উঠবে হিমালয় থেকে সুন্দরবন? গোপালগঞ্জের মিশনারি স্কুল কিংবা কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজে থাকতে রোগাটে সেই ছেলেটা কি কল্পনা করেছিল তার জন্য অপেক্ষা করছে একটা জাতি? কোনোটারই উত্তর আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু জানি, অদৃষ্ট বাঙালি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার জন্য তাঁকে মনোনীত করেছিল। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই বলা হচ্ছে। ব্রিটিশ বাংলায় বিভিন্ন অধিকার আদায়, পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার তৎপর ভূমিকা যে কোনো রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিকে বিস্মিত করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একটা অংশের হাতে ধানমণ্ডির বাসভবনে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করার আগে অব্দি তার সামগ্রিক ধ্যান ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে জাতির মুক্তি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক কিংবা মাওলানা ভাসানী যে কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় রেখেছিলেন; তার পূর্ণতা ঘটে তাঁর হাতে। আর এজন্যই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। জাতির পিতার জন্মের এই শতবর্ষ পরেও তাঁকে জানার জন্য আগ্রহ বাড়ছে বই কমছে না। প্রকাশ পাচ্ছে নানা নথিপত্র, লেখা হচ্ছে স্মৃতিকথা ও বই আর নির্মিত হচ্ছে ডকুমেন্টারি। বঙ্গবন্ধুকে জানার সেরা দশটি বই পরিচিত করিয়ে দিতেই আজকের আয়োজন।

১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী
কোনো মানুষ সম্পর্কে জানার সবচেয়ে বড় উপায় তাঁর চিন্তার সাথে পরিচিত হতে পারা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও চিন্তার একটা বড় অংশ ধরা পড়ে তার স্মৃতিকথাতে। ঘটনাটা ২০০৪ সালের। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে অনেকটা আকস্মিকভাবেই আসে পিতার জীর্ণপ্রায় চারটি খাতা। বস্তুত তা ছিল ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের লিখতে শুরু করা আত্মজীবনী। নিজের বংশ পরিচয়, শৈশব, শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কথা বিবৃত হয়েছে এই বইয়ে।

জীবনের প্রথম বড় অংশের প্রধান দলিল অসমাপ্ত আত্মজীবনী

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, প্রাদেশিক মুসলিম লিগের অপশাসনের পাশাপাশি উঠে এসেছে নীতি এবং আদর্শ। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে জাতির জনকের সামগ্রিক জীবন সম্পর্কে জানতে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রামাণ্য দলিল এটি। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়।

২. কারাগারের রোজনামচা
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে কারাগারেই কাটিয়েছেন ১৪ বছর। সেই ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো যেতে হয় অধিকার আদায় আন্দোলনের জন্য। পাকিস্তান আন্দোলনের পর তা যেন আরো চরমে ওঠে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ অব্দি ছিলেন পাঁচ দিন। তারপর থেকে দফায় দফায় তাকে আটক ও কারাবন্দী করা হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেষবারের মতো কারাবন্দী হবার আগে ডাক দিয়ে যান স্বাধীনতার। পাকিস্তান সরকার যে তাকে নিয়ে ভীতিতে ছিল; তা স্পষ্ট।

মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য দফায় দফায় জেলে গিয়েছেন মানুষটা

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ অভিযাত্রাকে তুলে আনার দিনপঞ্জি কারাগারের রোজনামচা। পঙক্তিতে পঙক্তিতে ফুটে উঠেছে বাঙালির সার্বভৌমত্ব অর্জনের বিশ্বাস। বাংলা একাডেমি থেকে ২০১৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় বইটি।

৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি (দুই খণ্ড)
সম্পাদনা এবং প্রামাণ্যকরণ পরিষদে ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত, গাজীউল হক, মুস্তাফা নুরউল ইসলাম, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবং আশফাক-উল আলম। বাংলা একাডেমি থেকে ২০০৮ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত বইটি এখন অব্দি বাংলা ভাষায় লেখা সবচেয়ে পরিপূর্ণ প্রামাণ্য গ্রন্থ। গ্রন্থটিতে শৈশব, কৈশোর এবং ছাত্রজীবনে কিভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হলেন—তার বর্ণনা যেমন আছে; তেমনি আছে মুজিবের নেতৃত্ব বিকাশের ইতিবৃত্ত।

বইটি জাতির জনকের পরিপূর্ণ তথ্যকোষ হিসাবে কাজ করবে

প্রথম ভাগে ব্রিটিশ ভারতে মুজিবের প্রস্তুতি, দ্বিতীয় ভাগে সাতচল্লিশ-পরবর্তী বাংলার আন্দোলন ও সংগ্রামের গল্পে নেতৃত্ব, তৃতীয় ভাগে স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু, চতুর্থ ভাগে পাক কারাগার এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, পঞ্চম ভাগে রাষ্ট্রনায়কের আসনে এবং ষষ্ঠ ভাগে একটি সরল উপসংহার টানা হয়েছে। বাড়তি হিসাবে পরিশিষ্টে বিভিন্ন তথ্য-তত্ত্ব, আলোকচিত্র এবং চিঠির সংযোজন।

৪. ওঙ্কারসমগ্র
বঙ্গবন্ধুর প্রধান কিছু গুণের মধ্যে ছিল বাগ্মীতা। যেখানেই গিয়েছেন, বিন্যস্ত শব্দচয়ন এবং আবেগধর্মী বর্ণনায় মাতিয়ে তুলেছেন শ্রোতা সমাবেশকে। এরকম শতাধিক ভাষণ থেকে বাছাই করে গুরুত্বপূর্ণ ৬৭টি ভাষণের শ্রুতিলিপি আকারে সংকলিত করেছে—ওঙ্কারসমগ্র। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত বইটির শ্রুতিলিখন ও সম্পাদনার কাজটি করেছেন তরুণ কথাসাহিত্যিক নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। শুরু হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ ঢাকায় দেওয়া ভাষণের মধ্য দিয়ে আর শেষ হয়েছে ৮ মার্চ ১৯৭৫ সালে টাঙ্গাইলে দেওয়া ভাষণের মাধ্যমে।

বাঙালির জাতীয় মুক্তির কথা ছিল তাঁর বক্তৃতায়

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ আচরণের বিবরণী উঠে এসেছে ভাষণগুলোতে। এসেছে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলার মানুষকে অধিকার সচেতন করে তোলার প্রয়াস এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির প্রচেষ্টা। দল, মত নির্বিশেষে যে কোনো বাঙালির কাছে ভাষণগুলো অন্যরকম তাৎপর্য নিয়ে ধরা দিতে পারে।

৫. শেখ মুজিব আমার পিতা
এই বইটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার লেখা স্মৃতিকথামূলক আত্মজৈবনিক রচনাগ্রন্থ। রাজনৈতিক শেখ মুজিবের বাইরে এসে বইটিতে ধরা দিয়েছে ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের নানা অজানা তথ্য।

বস্তুত বইটিতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ এক অন্য যুগে প্রবেশ করে। অথচ সেই শৈশব থেকেই মানুষটা কেবল জনতার জন্য খেটেছেন। ঘুরেছেন জায়গায় জায়গায়। জেল খেটেছেন লম্বা সময়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করার প্রত্যয় ছিল তার। ঘরোয়া বৈঠকেও উঠে আসত সেইসব স্বপ্নের কথা। সন্তানদের নৈতিকভাবে দৃঢ় করার জন্য মনোযোগ দিতেও ভুল করেননি; যার প্রমাণ আজকের প্রধানমন্ত্রী নিজেই। আগামী প্রকাশনী থেকে বইটি প্রথমবার প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। [চলবে]

৬. বাংলাদেশ
বইটি শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, নির্দেশনা, সাক্ষাৎকার এবং দুর্লভ কতিপয় ছবির সংকলন। এছাড়া তাঁর উপাধিসমূহ, সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং কিছু ঐতিহাসিক দলিলপত্র যোগ করা হয়েছে। সম্পাদনায় ছিলেন আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, কাজী সিরাজুল ইসলাম এবং মো. জাহিদ হোসেন।

বইটি ভবিষ্যত গবেষণায় দলিল হিসাবে গণ্য হতে পারে

‘নেতাকে যেমন দেখিয়াছি’ দিয়ে শুরু হয়ে পরপর ৮টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। সবগুলোই বঙ্গবন্ধুর লেখা। পরবর্তী অংশে আছে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায়মূলক বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনায় বিবৃতি ও বক্তৃতা। ১৯৮০ সালের লাহোর প্রস্তাব থেকে শুরু করে ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তচুক্তিও তুলে ধরা হয়েছে দলিল হিসাবে; যা ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। বইটি প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি থেকে।

৭. বঙ্গবন্ধু: জননায়ক থেকে রাষ্ট্রনায়ক
জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সম্পাদিত এই গ্রন্থটিতে আলো ফেলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের অজানা, আধা-অজানা বিষয়ে। একদিকে উন্মোচিত হয়েছে সংগ্রামী জীবনালেখ্য আর অন্যদিকে রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা।

চোখে ও স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুর জানা অজানা দিক

শামসুর রাহমান থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা অব্দি পাঞ্চাশের অধিক দেশবিখ্যাত ব্যক্তিদের চোখে ও স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুকে নির্মাণ করা হয়েছে পুনরায়। ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করাটা এই সময়ের দাবি হিসাবে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আগেই বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১০ সালে অন্বেষা থেকে প্রকাশিত হয় বইটি।

৮. শেখ মুজিব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। পল্টনে নাজিমুদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ঘোষণা বাংলার ক্ষুব্ধ মানুষের মনকে আরো তাতিয়ে দেয়। সেই ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই দফায় দফায় চলে টানাপোড়েন। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সরকার গঠন, শিক্ষা আন্দোলন, সংবিধান প্রণয়ন, ছয় দফা, গণঅভ্যুত্থ্যান এবং সবিশেষ স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই দীর্ঘ যাত্রায় বঙ্গবন্ধু প্রতিটা সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে।

বইটিতে মুখ্য হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক জীবন

শেখ মুজিব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম বইটি লিখেছেন মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি। উপসংহারসহ মোট নয়টি অধ্যায়ে লিখিত বইটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে তিল তিল যাত্রা এবং একজন রাজনৈতিক পাঞ্জেরি হিসাবে বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী ভূমিকা স্পষ্ট করে দেখা দিয়েছে। কাকলী প্রকাশনী বইটি প্রথম প্রকাশ করে ১৯৯৬ সালে।

৯. গণপরিষদ ও সংসদে বঙ্গবন্ধু
জনতার সাথে বিভিন্ন সভা সমাবেশে আন্দোলনের পাশাপাশি সমান তৎপরতা ছিল পাকিস্তানি গণপরিষদ এবং স্বাধীন বাংলার সংসদে। গভর্নর ও গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা, পূর্ব বাংলার মানুষের সাথে বৈষম্যমূলক নীতি, সংসদের কর্মসূচির বাংলায় মুদ্রণ প্রভৃতি বিষয়ে তার মতামত ছিল সুদৃঢ়। ধর্মনিরপেক্ষতা, চাকুরি, ভাষা কিংবা মুদ্রার ব্যাপারেও তিনি সমালোচনা করেছেন পাকিস্তানি নীতির।

বঙ্গবন্ধুর সংসদ জীবন গ্রন্থিত এখানে

দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির জন্য নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক গণপরিষদ ও সংসদের ঘটনাবলি উঠে এসেছে আনু মাহমুদের কলমে। ন্যাশনাল পাবলিকেশন থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় বইটি।

১০. ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের জন্যই বিশেষ চক্রের কাছে তিনি শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। তার প্রমাণ আগরতলা মামলা দিয়ে শুরু। তারপর নানা সময়ে দেশের ভেতর কিংবা বাইরের, জটিল কিংবা নিষ্ঠুরতার। এই বইটি মূলত জনকের হত্যার জন্য ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের অন্ধকারে আলো ফেলার প্রচেষ্টা। পাহার সমান দৃঢ়তা নিয়ে দণ্ডায়মান এক মহাপুরুষকে কিভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হলো তার তত্ত্ব ও তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রহস্য নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা তুলে ধরা হয়েছে

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আহত লেখক এক দশক ধরে অনুসন্ধান চালান ঘটনার গিঁট উন্মোচনে। বিভিন্ন ডকুমেন্টস, রেফারেন্স, নোট এবং সাক্ষাৎকার একত্রিত করেন বৃহৎ কলেবরে; যাতে উঠে এসেছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিক্রমা। অধ্যাপক আবু সাইয়িদের লেখাটি চারুলিপি থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে।

   

বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের প্রেরণা



তোফায়েল আহমেদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি দুনিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা এই আগস্ট মাসে হারিয়েছি। শোকাবহ আগস্টের সেই কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ জাতির পিতার পরিবারের অন্য সদস্যরা-তাদের সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। বঙ্গবন্ধুর কাছেই শুনেছি, তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উপলব্ধি করেছি, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।’ সেই লক্ষ্য সামনে রেখে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন; কোনোদিন মাথা নত করেননি তিনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। আজ তিনি টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত। আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না, দরদি কণ্ঠে বক্তব্য রাখবেন না। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাকে আন্দোলিত করে। বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের চলার পথের প্রেরণা। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সংবর্ধনা দিয়ে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম, সেই থেকে শেষদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলাম।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী নেতা। ’৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সামরিক সরকার প্রণীত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার তথা এলএফও’র অধীনে। অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে এলএফও’র অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি এটা প্রমাণ করতে যে, কে বাংলার মানুষের নেতা।’ ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিনের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘৬ দফা আজ আমার না, আমার দলেরও না, এই নির্বাচনের মাধ্যমে ৬ দফা আজ জাতীয় সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যদি কেউ ৬ দফার সঙ্গে বেইমানি করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু ৬ দফাকে আপসহীন পর্যায়ে উন্নীত করেন। ’৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গভবনে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা হলে বলেছিলেন, ‘মিস্টার ভুট্টো, পাকিস্তান আর্মি ষড়যন্ত্র করছে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে। তুমি পাকিস্তান আর্মিকে বিশ্বাস কোরো না। ওরা প্রথমে আমাকে হত্যা করবে, পরে তোমাকে।’ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যা করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়। এরপর ঠিকই পাকিস্তান আর্মির জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘এরপর কী হবে?’ বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন, ‘এরপর ইয়াহিয়া খান আসবে। ইয়াহিয়া খানকে অনুসরণ করে একটা টিম আসবে। সেই টিম নিয়ে একদিন আমার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে হঠাৎ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালাবে। আর সেদিনই পাকিস্তানের সমাধি রচিত হবে।’ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কী নিখুঁত বিশ্লেষণ! পরবর্তীকালে এসব ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব রূপ আমরা দেখেছি।

জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি ধাপেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ বাংলা ও বাঙালির জন্য তার হৃদয়ের ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের দরদ ও ভালোবাসার গভীরতা অপরিমেয়। দলীয় কর্মীদের দেখতেন পরিবারের সদস্যের মতো। সব সময় বলতেন, ‘নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়-এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান।’ এমনকি বিরোধী নেতাকর্মীদের প্রতিও তার গভীর সহমর্মিতা ছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ১৮ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসি। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৪ জানুয়ারি আমাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তার রাজনৈতিক সচিব করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর ছিল ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সফরসঙ্গী হিসাবে দেখেছি কলকাতায় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভা। ২০ লক্ষাধিক মানুষের উদ্দেশে বক্তৃতার শেষে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’ এরপর রাজভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠকে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। বৈঠক শেষে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার জন্মদিনে আপনাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু পুনরায় বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সফরের আগেই আমি চাই ভারতের সেনাবাহিনী আপনি ফিরিয়ে আনুন।’ ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আপনি যা চাইবেন আমি তাই করব।’ ’৭২-এর ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ১২ মার্চ বিদায়ি কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেন। একই বছরের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন জুগিয়েছে। সেদিন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন এবং ক্রেমলিনে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ-কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। এটি ছিল বিরল ঘটনা। ’৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। সব নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুসহ ৬ জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরদিন তিনি ইসলামিক সম্মেলনে যান। সেদিন লাহোরে দেখেছি মানুষ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলেছে ‘জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ। লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরুই হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্য সম্মেলন একদিন স্থগিত ছিল। ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর, জাতির পিতা জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু আত্মমর্যাদাবান নেতা, তার প্রতি বিশ্ব নেতাদের গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। যেখানে গিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। স্বাধীনতার পর অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও দক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ অব নেশনস, ওআইসি, ন্যামসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে।

বঙ্গবন্ধুর সমগ্র চিন্তাজুড়েই ছিল দেশ ও দেশের মানুষ। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির কাজ শুরু করেন। স্বাধীনতার পর দেশ ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। গোলাঘরে চাল, ব্যাংকে টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। রাস্তা-ঘাট ধ্বংস করে দিয়েছিল হানাদার বাহিনী। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। প্লেন, রেল ছিল না। পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা তছনছ। মাত্র ৩ বছর ৭ মাস উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশটাকে আমরা স্বাভাবিক করি। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেদিন উদ্বোধন করা হয় সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। রাষ্ট্রের যত প্রতিষ্ঠান তার সবকটির ভিত্তি স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। এতসব কিছুর পর যখন দেশটাকে স্বাভাবিক করে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। অথচ তখন গোলাঘরে চাল, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা এবং দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল।

সুদৃঢ় নীতি, আদর্শ ও সংকল্পবোধ নিয়ে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠনে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে খুনিচক্র তাকে দেশের অভ্যন্তরে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেই খুনিচক্র ক্ষান্ত হয়নি। একই বছরের ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে-বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছেন-জাতীয় চার নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি করা। কিন্তু ঘাতকচক্রের ষড়যন্ত্র আমরা সফল হতে দেইনি। আওয়ামী লীগের রক্তে ভেজা পতাকা দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়ে সেদিন আমরা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলাম। আজ তা প্রমাণিত। জাতির পিতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ভিত্তিভূমি তৈরি করে দিয়ে গেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে, শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন। নিষ্ঠা, সততা ও সাহসের সঙ্গে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন এবং দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে জাতিকে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ-সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

[email protected]

;

১৫ আগস্ট: আজ শোকের দিন



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকী আজ।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দিবসটি পালন করবে। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সর্বশেষ খবর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার গুগল নিউজ চ্যানেলে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে আছে-সূর্য উদয় ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে সংগঠনের সকল স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ।

বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল এবং টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং আলোচনা সভা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।


পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্তবাবু, মেয়ে বেবি, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।

এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।

মূলত, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকেই বাংলাদেশে এক বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু হয়। বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসনের অনাচারী ইতিহাস রচিত হতে থাকে।

সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।

দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় 'সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।

একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।'

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে।

পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামী বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন।

১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ৬ আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।

১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ স্বাধীনতা-বিরোধী চক্রের নানা বাধার কারণে ৮বার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।

এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

অন্যদিকে, ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন।

কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন।

পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে।

দীর্ঘ ৬ বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের ৩ সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।

২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়।

২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।

২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরও একজন খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার ৪৫ বছর, নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের মামলার ২৫ বছর এবং উচ্চ আদালতের রায়ে ৫ আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রায় ১০ বছর পর গ্রেপ্তার হয় খুনি মাজেদ।

;

পনের আগস্ট ও হত্যার রাজনীতি



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যখন নতুন রাষ্ট্র রূপে স্বাধীন বাংলাদেশ কেবল তার যাত্রা শুরু করেছে, তখন তার সামনে ছিল পাহাড়প্রমাণ সমস্যা। যার সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা। এমতাবস্থা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এক গভীর ষড়যন্ত্রেও অংশ। পরবর্তীতে জাতীয় চারনেতার হত্যাকা- হত্যার রাজনীতির নতুন ক্ষত সৃষ্টি করে এবং এসব নৃশংস হত্যাকা- সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।

পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর ব্রিটেন ও ভারত হয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দীর্ঘ আন্দোলনের সফলতায় যে স্বপ্নের বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে, তা পুনর্গঠনের প্রত্যয়ে তিনি তখন দীপ্ত। যুদ্ধের ফলে বিধ্বস্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রতীতে তিনি শুরু করেন জীবনের আরেক অধ্যায়।

অনেকে ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নেবেন না। কারণ, তিনি তখন আর দলীয় নেতা নন, সমগ্র বাংলাদেশের আপামর মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু বাঙালির স্বার্থে ও বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি সরকারপ্রধান হন। ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সরকার ঘোষণা করে ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’। ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ২ হাজার ৮৪৮ জনের। দ-প্রাপ্ত হয় মাত্র ৭৫২ জন দালাল তথা পাকিস্তানি দোসর। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।

একই সময়ে বঙ্গবন্ধু মনোযোগ দেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো বিনির্মাণের কাজে। শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করে তিনি শিল্প-উৎপাদনের ৮৫ ভাগ সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এদিকে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় খরা ও মন্দা দেখা দেয়, যা ছিল যুদ্ধে প্রায়-ধ্বংস দেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় স্বরূপ। খরাজনিত দুর্ভিক্ষের কারণে সৃষ্টি হয় নানামুখী সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, যা মোকাবেলা করার কঠিন চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতে হয়। প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় অর্থের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। যদিও তখন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে কিছু অসন্তোষ ধূমায়িত হয়, যার নেতৃত্ব দেয় অতি-ডান ও অতি-বাম উগ্রবাদী দলগুলো।

সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনে একই সময়ে পুঞ্জিভূত হতে থাকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ¯œায়ুগত লড়াই, যার একদিকে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ আর বিপক্ষে পাকিস্তান প্রত্যাগতরা। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তৎকালে কর্মরত বাঙালি সৈনিকের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০ হাজার। যাদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার আটক ছিল পাকিস্তানে। বাংলাদেশে যে ১৪-১৫ হাজার সৈন্য ছিল, তাদের অনেকেই যুদ্ধে আহত-নিহত হন আর বাদবাকী অধিকাংশই ছিল যুদ্ধাহত, পঙ্গু ও রণক্লান্ত। তাদের পক্ষে এসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রাধান্য ঠেকানো ও অপতৎপরতা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় নি। ফলে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দাপট বাড়তে থাকে, যারা সরকারকে নানাভাবে বিব্রত ও স্যাবোটাজ করতে থাকে।

এমতাবস্থায় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নতুন দেশের নতুন সরকারের অধীনে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ধারা দৃঢ় ও অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে নির্বাচন শতভাগ বিতর্কহীন হতে পারে নি। বিরোধী দলগুলোও হটকারিতা ও নানা সমালোচনায় মুখর হয় নির্বাচন প্রসঙ্গে। যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে বিপুল বিজয় পাবে, তা ছিল খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন না করায় আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো তখন চরমভাবে সমালোচনা ও আন্দোলনমুখর হয় এবং অতিউগ্র কিছু দল নাশকতামূলক কার্যক্রম শুরু করে। ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী’ নামে একটি নতুন সশস্ত্র সংস্থা গঠন করে, যার কার্যকলাপ নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে বির্তক সৃষ্টি হয়। তদুপরি, অপরাপর বাহিনীগুলোর সঙ্গে এই নতুন বাহিনীর দূরত্ব ও মতপার্থক্যও দেখা দেয়।

এতকিছুর পরেও দেশকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় পরিচালনার জন্য সরকার সচেষ্ট হয়। সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুদ্ধের ক্ষত নিয়েই সংসদীয় ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখে। এমন কৃতিত্ব যুদ্ধ-পরবর্তী দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ। যদিও দেশে তখন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর, প্রশাসন, সিভিল সোসাইটি ও রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং আইন-শৃঙ্খলা নাজুক। নানা রকমের অন্তর্দ্বন্দ্ব পেরিয়ে সরকার শাসনের ধারা অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট হয়। যদিও সরকার দলের ছাত্র সংগঠনের ভাঙনের ফলে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হয় নতুন দল জাসদ, যারা তীব্রভাবে বিরোধিতার রাজনীতি শুরু করে। সরকার এসব সামাল দিয়েও দেশের জন্য নানা রকমের নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে চলতে থাকে। যার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ড. কুদরাত-ই-খুদার শিক্ষা কমিশন অন্যতম। সরকার ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি করে, বিরোধীরা যার তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়। সরকার-বিরোধী আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হয়ে দুনীতি, স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে সরব হয় এবং দেশব্যাপী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়। এর ফলে মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিত হয়। এর ২৭ দিন পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। ৭ জুন দেশে একক জাতীয় দল হিসাবে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করা হয়, যাতে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সৈনিক, আমলা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের নেওয়া হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’।

গবেষকরা মনে করেন, প্রতিকূল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দিতে বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর সূচনা করেছিলেন। এতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। দ্রব্যমূল্য ও অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এদিকে ১ সেপ্টেম্বর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ তথা ‘বাকশাল ব্যবস্থায়’ নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু হত্যার এই নির্মম ঘটনার চার মাস পর ৩ নভেম্বর নিরস্ত্র অবস্থায় জেলে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চার জাতীয় নেতা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে তাঁদের প্রত্যেকের নাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। দীর্ঘ ২৫ বছর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করার সাধনায় নিয়োজিত থাকার পর তাঁরা স্বাধীনতার নয় মাস জাতির মুক্তির লক্ষ্যে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের হত্যার মাধ্যমে এটা “বোঝা গেল যে, হত্যাকারীদের ক্রোধ কেবল বঙ্গবন্ধু-পরিবারের মধ্যে সীমিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও সে আদর্শের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোও ছিল তাদের আক্রোশের লক্ষ্য” বলে মনে করেন বদরুল আলম খান তার সংঘাতময় বাংলাদেশ: অতীত থেকে বর্তমান, (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৫, পৃ. ২১৯) গ্রন্থে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

বঙ্গবন্ধুকে ‘মহান মানবতাবাদী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিশ্বনেতাগণ



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সরকার প্রধানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপোষহীন ও মানবতাবাদী নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মহান স্বপ্নদ্রষ্টা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মতি যাদুঘর পরিদর্শনকালে বিশ্বনেতারা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

তারা ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে রক্ষিত পরিদর্শক মন্তব্য বইয়ে এই মূল্যায়ন তুলে ধরেন।

"বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল এবং সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের মত ঘটনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে খুবই বিরল। মহান একজন মানবতাবাদী হিসেবে তিনি সকল মানুষের জন্য সমতা, সুযোগ ও মর্যাদার মহান প্রবক্তা।"

নগরীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন শেষে মন্তব্য লেখার জন্য রক্ষিত বইয়ে এ মন্তব্য করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এতে তিনি আরো বলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। ভারতের জনগণের পক্ষে আমি একজন মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্কের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।"

মোদি ২০১৫ সালের ৬ জুন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ বলেন, "আমি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের মহান আত্মত্যাগ দেখে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত এবং তিনি তাঁর দেশের মানুষের সেবা করেছেন। আমি বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সকল সদস্য যারা অকালে নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।"

কোবিন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধুর দেখানো আদর্শ ও মূল্যবোধ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখাবে। বাংলাদেশের প্রিয় জাতির পিতার জীবন ও কর্মের সাক্ষ্য দেওয়া ভবন পরিদর্শন করে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা।

ভারতের সাবেক এই রাষ্ট্রপতি ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইয়োলড্রিম ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় মন্তব্য বইয়ে তিনি লেখেন, বাংলাদেশের মহান স্থপতি এবং বাঙ্গালী রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিধন্য বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন আমার জন্য খুবই সম্মানের বিষয়। বঙ্গবন্ধু কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী সামরিক অফিসারদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ৪০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান এখনও ২০ শতকের একজন অন্যতম নেতা হিসেবে স্মরণীয় ও বরণীয়।

তিনি বলেন, "তুরস্কের জনগণ এবং মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পক্ষ থেকে আমি একজন মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাংলাদেশ সফরকালে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করে আমি ব্যক্তিগতভাবে যা প্রত্যক্ষ করেছি, তা আমার হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমি বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই যে আমরা বাংলাদেশের স্থপতি প্রয়াত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একই উষ্ণ ভাবাবেগে ডুবে আছি এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।"

মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহীম মোহামেদ সলিহ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের সংগ্রাম বাংলাদেশকে তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পথকে তৈরি করেছে। তিনি গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার লাভের ক্ষেত্রে আইকন হিসেবে সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং তাঁর আদর্শ বাংলাদেশ ও বিশ্বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তিনি ২০২১ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালী জাতির অধিকার ও মর্যাদা আদায়ে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গভীর তাৎপর্যপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁকে দেওয়া বঙ্গবন্ধু খেতাবে দেশের মানুষের প্রতি এই দেশপ্রেমিক নেতার গভীর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়।

এতে তিনি আরো বলেন, 'আমাদের দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্রতী এই মহান স্বপ্নদ্রষ্টা ও বিশ্ব রাষ্ট্রনায়ককে আমি অভিবাদন জানাই।'

তিনি ২০১৩ সালের ৪ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

জার্মানীর প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিয়ান উলফ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, এই স্মৃতি জাদুঘর আমাদের একজন মহান রাষ্ট্রনায়ককে স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি তার জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াই করেছেন এবং অতিদ্রুত স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমি বাঙ্গালী জাতির স্থপতি এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানাই।'

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সম্মোহনী এবং অসীম সাহসী নেতৃত্বে মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর জনগণকে নেতৃত্ব দান করেছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমি একজন মহান দূরদর্শী এবং রাষ্ট্রনায়কের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি যিনি স্বাধীন, উন্নত এবং গর্বিত বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।'

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী বলেন, 'দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন নেতা এবং রাষ্ট্র নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি স্বাধীনতার জন্য প্রতিকূলতা ও বিরূপ পরিস্থিতি উপেক্ষা করে অটল সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছেন।'

সোনিয়া বলেন, 'বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক এবং সমতার ভিত্তিতে মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে তার জনগণকে ক্ষমতাবান করতে চেয়েছিলেন। স্বাধানীতার পরপরই বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। তাঁর আত্মত্যাগ সব সময় সম্মানিত হবে, পরবর্তী প্রজম্ম এ আত্মত্যাগকে সম্মান করবে এবং এ সম্মান অব্যাহত থাকবে। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।'

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় বলেন, এই উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু এক জলন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি এবং পিতা।

মমতা বলেন, বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মঞ্চে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বে মর্যাদা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই বিরল নেতা, যার প্রতি ধর্মমত নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রণাম জানিয়ে ধন্য হয়। তার স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।

শান্তিতে নোবেল জয়ী কৈলাশ সত্যার্থি বলেন, আমার আবেগ ও অনুভূতি জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এই স্থানটি সত্যিকারভাবেই একটি তীর্থভূমি, প্রার্থনার একটি পবিত্র স্থান, যারা মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার ও কল্যাণে বিশ্বাস করে।

২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন শান্তিতে এই নোবেল বিজয়ী।

কৈলাশ সত্যার্থি বলেন, এই স্থানটি ভৌগলিক সীমা ও সময় অতিক্রম করেছে, কারণ বঙ্গবন্ধু নিজের সত্ত্বাকে সার্বজনীন ও অমর করে রেখে গেছেন।

তিনি বলেন, আমি প্রার্থনা করি, এখানে যে ধরণের সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা হয়েছে, তার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং কোথাও যেন এ ধরণের ঘটনা না ঘটে। পৃথিবী যেন মানবিক ও সভ্য হয়, যেখানে একটি বন্দুকের গুলিও যেন তৈরি না হয় ও তার ব্যবহার যাতে না হয়।

কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জ্যাং স্যাং মিন ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি পরিদর্শক বইয়ে মন্তব্য করেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য সারাজীবন যে লড়াই সংগ্রাম করেছেন তার প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি শান্তির পায়রার মতো তাঁর দেশের মানুষের স্বাধীনতাকে ভালবাসতেন, যার মূল্য সার্বজনীন। তাঁর (বঙ্গবন্ধু) স্বাধীনতার সংগ্রাম ভবিষ্যতের জন্যও অব্যাহত থাকবে।

কোলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে প্রণাম। ভারতের মাটিতে থেকেও আমরা 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে উদ্বেলিত হয়েছি। ৭ মার্চের আপনার কবিতা বাঙালী হিসেবে আমাকে, আমাদের আজও দোলা দেয়। বাঙালী জাতিকে যেন কেউ দাবায়ে রাখতে না পারে-এই আর্শিবাদ প্রার্থনা করি।

তিনি ২০২৩ সালের ১০ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সামরিক সরকার বাড়িটিতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান)।

১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরেও তাঁকে বাড়িটিতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পরে একই বছরের ১০ জুন তিনি বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতি পান।

১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট এ বাড়িটিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেন।

;