বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতপার্থক্য, ভিন্নমত থাকলেও তা যেনো কোনভাবে ঐক্যে ফাটল না ধরায় সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক ঐক্য আয়োজিত 'সংকট থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের বিকল্প নেই' শীর্ষক আলোচনা সভার বক্তারা।
বুধবার ( ১২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর বিজয়নগরে হোটেল ফার্সে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
বক্তারা বলেন, ঐক্যমত মানে একমত হওয়া নয়। প্রতিটা রাজনৈতিক দল, সামাজিক নেতৃত্বের আলাদা মতামত থাকবে তবে দেশ, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার নিয়ে সবার মতামত হবে এক ও অভিন্ন। বাকি সব বিষয়ে দলগুলো তাদের দলীয় অবস্থান ব্যক্ত করবে এতে জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে কোন সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয় না।
তারা আরও বলেন, সরকারের নানা বিষয়ে ব্যর্থতা আছে, সেগুলো আমরা তুলে ধরবো, সরকারকে চাপ প্রয়োগ করবো সেগুলো ঠিক করতে কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে আমরা সরকারের বিপক্ষে। আমরা সরকারের পতন চাই। বরং আমরা এই সরকারকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সফল করতে চাই। আমাদের ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান সহস্র শহীদের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে চাই।
ঐক্যমতের ক্ষেত্রে ১৭ কোটি মানুষের কাছে একই মত পাওয়া সম্ভব নয়, যাওয়াও সম্ভব নয়। যেহেতু রাজনৈতিক দল গুলোর মানুষের বা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে তাহলে রাজনৈতিক দল গুলো ঐক্যমত হলেই জাতীয় ঐক্যমত হওয়া সম্ভব। কারণ সরকার জাতীয় ঐক্যমত করতে গেলে রাজনৈতিক দল গুলোর কাছেই আসবে। জাতীয় ঐক্যমতের বৈধতার ক্ষেত্রে গণভোটের বিকল্প নেই। এটার মাধ্যমে ঐক্যমত পৌঁছাতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ৫ আগস্টের পর অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেই সাথে চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ঐক্যমতের বিকল্প নেই। ঐক্যমতের মাধ্যমে সব সম্ভব। জাতীয় ঐক্যমতের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড মুহাম্মদ ইউনূস।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ৬ মাস পরে আমরা আজ অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছি, এর আগে কোন গণঅভ্যুত্থানে দেখতে পাইনি। আমাদের ফোকাসটা মনে হয় বেশি করে ফেলছি। ইউনুস সাহেব কিন্তু আমাদের সম্পদ। এই সংকটের মধ্যে ইউনুসকে (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পেয়েছি এটা জাতির জন্য আশির্বাদ কিন্তু এখন সে পথে হাটছি না। প্রথমেই উনি উনার ক্যাম্পাসটা অনেক বড় করে ফেলেছেন, এই স্বল্পকালীন সরকারের এত বড় ক্যানভাস করার প্রয়োজন ছিলো কি না এটা আমার ব্যক্তিগত প্রশ্ন।
নির্বাচন হলেই কি সমস্যার সমাধান হবে এমন প্রশ্ন অনেকেই করতে পারেন উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, নির্বাচন হলেই সমস্যার সমাধান হবে। কারণ তারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবে। তাদের একটা জবাবদিহিতা থাকে। তাই নির্বাচনের কোন বিকল্প নাই। জনগণের জন্মগত অধিকার ভোটই তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। এই ভোটের প্রেক্টস যদি শুরু করতে পারি তাহলে জনগণ তাদের অধিকার আদায় করে নিবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, নতুন বন্দোবস্ত মানে এদেশের রাজনীতি, ক্ষমতা কিভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ণয় করা। তার মানে এই না যে আমরা সব বিষয়ে একমত হবো। আমরা ৩১ দফায়ও সবাই ঐক্যমত পোষণ করেছিলাম তার মানে এই না যে আমরা প্রতিটা দফায় একমত ছিলাম। নির্বাচন সংস্কারের একটা অংশ, নির্বাচনের জন্য অনেকগুলো সংস্কার দরকার। আমরা আসুন সংস্কারগুলো নির্দিষ্ট করি, আগামী নির্বাচন পার্লামেন্ট ও সংবিধান সংস্কার সংবিধান পরিষদ গঠনে একমত হই।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্খা তা এখনো পূরণ হয়নি। এমনকি ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান এর যে ঐক্য সেটাও বাস্তবায়ন হয়নি। সেটার উপর দাঁড়িয়ে ২০২৪ এ যে অভ্যুত্থান হলো তা ত আরও আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে। এখানকার গণঅভ্যুত্থান হাজার হাজার মানুষের রক্তের মধ্য দিয়ে। আজ ৬ মাসের পরে এসে আমরা জানতে চাই, কি কি করেছেন এই ৬ মাসে তা ত জানতেই পারি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, অভ্যুত্থান তখনই সফল হয়েছে যখন সকল ছাত্র, শ্রেনী পেশার মানুষ এবং রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নেমেছে তখনই সফল হয়েছে। এখনকার সরকারে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নেই। বাকি দুই স্টেকহোল্ডারের প্রতিনিধি আছে। এখন সংকট সমাধানের দায়িত্ব যদি ছাত্রদের উপর দিয়ে দেন তাহলে তাদের দেয়া রূপরেখায় আপনাদের বিশ্বাস করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন গঠনতন্ত্র পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন হতে পারবে না অথচ জাতীয় নির্বাচনের সময় আমরা চাচ্ছি অল্প সংস্কার করেই নির্বাচন হউক। এখানে কিন্তু আমাদের দুই ধরণের বক্তব্য হচ্ছে। আমরা জাতীয় নির্বাচন নিয়ে একরকম কথা বলছি আবার জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিপরীত ধর্মী কথা বলছি।
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, জাতীয় নেতৃত্বে বের করতে ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিন। এতে করে নেতৃত্বে বের হয়ে আসবে। ক্ষমতার পেছনে না ঘুরে। এখন আমাদের ভিতরে কথার ফুলঝুড়ি উঠেছে। কোন ঐক্যমত নেই। যত দিন যাচ্ছে সব কিছু ঝুলে যাচ্ছে। তাই সরকারকে বলি, বেশি বেশি সংস্কারের কথা বলে, কুসংস্কার করবে না। যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। না হলে মঈন উদ্দিন ফখরুদ্দিনের মতো পালাতে হবে। এখন তো দেখি সরকার থেকে কিংস পার্টি করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ এর সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন স্বপন বলেন, ১৫ বছর রাজনৈতিক দল গুলো আন্দোলন করে ফ্যাসিবাদ পতন ঘটাতে পারিনি। কিন্তু ছাত্ররা সেটি পেরেছে। তাদেরকে বাদ দিয়ে কোন রাজনৈতিক ঐক্যমত করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাদের অংশীজন হিসেবে রাখতে হবে। যাতে আগামীতে কেউ ফ্যাসিবাদ না হয়ে উঠে।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ৭১ কে বাদ দিয়ে কিছু করতে দেয়া হবে না। কেউ বলে মহান গণঅভ্যুত্থান, কেউ বলে বিপ্লব? কিন্তু বিপ্লব ও মহান অভ্যুত্থান আলাদা সংজ্ঞা রয়েছে। দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়নি, স্বাধীন হয়েছে ৭১ সালেই।
ঐকমত্য কার সাথে কার এমন প্রশ্ন রেখে সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, ঐকমত্য দরকার সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে। রাজনৈতিক দল গুলোর সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর। এখানে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি সম্মান দেখানো প্রয়োজন। এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান সংস্কার বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। কেউ বলে পরিবর্তন চাই, কেউ চায় না। ৭১ এর ধারাবাহিকতায় ৯০ হয়েছিল, সেটার ধারাবাহিকতায় জুলাই অভ্যুত্থান। এ বিষয়টি সবাইকে ধারণ করার আহ্বান জানান তিনি।