বিশ্বকাপের স্মরণীয় সব ম্যাচ: মারাকানা ট্র্যাজেডি থেকে ঈশ্বরের হাত!

  ‘মরুর বুকে বিশ্ব কাঁপে’
  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

কিছু খেলা আছে গুণগত মান, ছন্দ, খেলোয়ারসুলভ আচরণের কারণে বিখ্যাত হয়ে যায়; মনে দাগ কেটে রাখে। কিছু খেলা আবার বিতর্ক তৈরি করে। আর যদি এর মধ্যে একটি বিশ্বকাপে হয়ে থাকে; তাহলে সেটা হবে নাটকীতয়তায় ভরা। বিশ্বকাপ আমাদের আবেগের চরম শিখরে নিয়ে যায়। গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ বিশ্বকাপ ফুটবল ঘিরে উন্মাদনার কমতি থাকে না ভক্তদের। একেকটি বিশ্বকাপ সমর্থকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে একেকটি ঘটনা। অনেক ঘটনা আবার জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কেরও।


ব্রাজিলের মারাকানা ট্র্যাজেডি ১৯৫০: ব্রাজিল ১-২ উরুগুয়ে

বিজ্ঞাপন

ব্রাজিলের বিখ্যাত নাট্যকার নেলসন রদ্রিগেজের বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘সবসময় অপরিবর্তনীয় কিছু বিপর্যয় ঘটে যায়। এর মধ্যে রয়েছে হিরোশিমার মতো কিছু। আমাদের হিরোশিমা- ১৯৫০ সালে উরুগুয়ে কাছে ফাইনালে হেরে যাওয়া।

প্রথম আসরেই বিশ্বকাপ আয়োজন করে শিরোপা জেতে উরুগুয়ে। ।তাও আবার ব্রাজিলে এসে। স্বাগতিকদের হারিয়ে সুয়ারেজ-ফোরলানদের দেশ জেতে ট্রফি।

বিজ্ঞাপন

উরুগুয়ে যখন স্বপ্নপূরণের আনন্দে ভাসছিল তখন মুদ্রার অন্য পিঠে ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন। যার নাম ‘মারাকানা ট্র্যাজেডি’। ঘরের মাঠে প্রথম শিরোপা জিততে জিততে হেরে যায় ব্রাজিল। অথচ বিশ্বকাপ জয়ের উৎসবের সম্ভাব্য সব আয়োজনই করেছিল সেলেকাওরা। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ড্র করলেই চলত স্বাগতিকদের। যেখানে ৬৫ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে ছিল সেলেকাওরা। ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে এরপরের গল্পটা প্রায়সবারই জানা। ১৩ মিনিটের মধ্যে দুই গোল হজম করে ব্রাজিল।

শোকে, হতাশায় বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত ব্রাজিল। মারাকানা স্টেডিয়ামে হয়ে ওঠে মৃত্যুপুরী। ২-১ গোলের হারে রচিত হয় ব্রাজিলের ‘মারাকানা ট্র্যাজেডি।’ ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে ওই হারটাই ছিল চিরকালীন এক আক্ষেপের নাম। পুরো আসরে দাপট দেখানো ব্রাজিল চূড়ান্ত ম্যাচে খেই হারিয়ে ফেলে। ফাইনাল ম্যাচের সেই ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক বারবোসাকে দুই গোল হজমের চড়া মাসুল দিতে হয়। আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। ২০০০ সালে ‘অভিশপ্ত’ গোলরক্ষকের মৃত্যুর পর ব্রাজিলের একটি সংবাদমাধ্যম শিরোনাম করেছিল, ‘বারবোসার দ্বিতীয় ম্যৃত্যু।’ তাহলে প্রথম মৃত্যুটা কখন? ওই যে পঞ্চাশের ফাইনালে!

বিশ্বকাপ ১৯৫০: ইংল্যান্ড বধ

১৯৫০ সালের আশেপাশের সময়টাতে বিশ্বফুটবল শাসন করেছে ইংল্যান্ড। ইংলিশরা তখন স্বীকৃতভাবেই বিশ্বসেরা। ফেভারিট আলোচনায় অনেকটা এগিয়ে থেকে ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল তারা। কিন্তু গ্রুপ পর্বে হারতে হয়েছিল তখনকার পুচকে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। বিশ্বকাপের অন্যতম অঘটন বলা হয় এটাকে। ওই বিশ্বকাপের পর টানা ৪০ বছর বিশ্বকাপে উঠতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। সেবার ইংল্যান্ডকে হারালেও গ্রুপ পর্ব পেরুতে পারেনি। আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হেরে সেবার গ্রুপ পর্ব পেরুতে পারেনি ইংল্যান্ডও। তখন গ্রুপ পর্ব থেকে একটি করে দল পরের রাউন্ডে যেতে পারত।


বিশ্বকাপ ১৯৭০: জুলে রিমে কাপ

১৯৭০ সালের ২১ জুন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রঙিন পর্দায় সম্প্রচার হয় ফুটবল বিশ্বকাপ। কিন্তু এর চেয়েও বড় এক ঘটনা সেদিন রচিত হয়েছিল ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে। ১৯৭০ সালে পেলের পায়ের জাদুতে বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল ব্রাজিল, সেই জয়ে বোধহয় মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন বিশ্বের সমস্ত ফুটবল্প্রেমীই।

এরকম জাদুকরী পারদর্শীতা নিয়ে হঠাৎ কখনো কখনো এক প্রজন্ম আসে হয়তো। ফুটবলে পটু ব্রাজিলিয়ানরা ৫ বার জিতে নিয়েছে বিশ্বকাপ। কিন্তু আজও ১৯৭০ সালের সেই জয়ের কিংবদন্তী মুখে মুখে ফেরে সবার।

সেবার ইতালির বিরুদ্ধে ৪-১ গোলে জেতে ব্রাজিল। শেষ গোলটা এসেছিল পেলের পায়ের জাদুতেই। কিন্তু ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই পায়ে পায়ে গোলটা সাজিয়ে তুলে দিয়েছিলেন পেলের পায়ে। এটাই তো যেকোন খেলার মূল ভিত্তি- দলগতভাবে একটা লক্ষ্যের জন্য কাজ করা।

২০১৬ সালে সাক্ষাৎকারে পেলে বলেছিলেন, 'সেবারের বিশ্বকাপটা আমরা জিতেছিলাম। আমার খেলোয়াড় জীবনের সেরা পাওয়া ছিল সেটা। সেবছর বিশ্বকাপ শুরু হবার আগে মেক্সিকোতে বসে আমি ভাবছিলাম এবার রিটায়ার করব। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, না এটাই আমার জীবনের শেষ বিশ্বকাপ। ঈশ্বর যেন আমাকে সেরা খেলাটা দেওয়ার সামর্থ্য দেন, সেই প্রার্থনা করলাম।'

 

১৯৬৬ বিশ্বকাপ: এশিয়া বিস্ময়

১৯৬৬ সালে এশিয়ার একমাত্র দল হিসেবে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। সমীকরণ ছিল গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটা জিতলে পরের রাউন্ডে যাবে উত্তর কোরিয়া। কিন্তু ওই স্বপ্ন ম্যাচের আগে কোরিয়ান সমর্থকরাও হয়তো দেখেননি! কারণ শেষ ম্যাচে উত্তর কোরিয়ার সামনে ছিল ইতালি। হট ফেভারিটও ছিল ইতালিয়ানরা। কিন্তু হট ফেভারিটরাই হেরে যায় উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে। পরের রাউন্ডে উঠে যায় উত্তর কোরিয়া আর গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে যায় ইতালি। বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা অঘটন বলা হয় ওই ঘটনাকে।

বিশ্বকাপ ১৯৮৬: হ্যান্ড অব গড

বিশ্বকাপটা ছিল ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ। আর ওই বিশ্বকাপ আলোচিত-সমালোচিত হয়ে আছে ডিয়াগো ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’- এর কল্যাণে। সেই বিশ্বকাপেই বিশ্ববাসী ম্যারাডোনার কাছ থেকে দেখেছিল ইতিহাস কাঁপানো দুই গোল।

বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ডের। ম্যাচে দুই পক্ষের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্যভাবে।

কিন্তু ম্যাচের ৫১ মিনিটে লাফিয়ে উঠে গোল করেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ম্যারাডোনা। গোল করার পরপরই ম্যারাডোনা তার সতীর্থদের সঙ্গে গোল উদযাপনে মেতে ওঠেন। অবশ্য ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটনসহ চার-পাঁচজন ইংলিশ ফুটবলার গোল বাতিলের দাবি জানিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন রেফারির দিকে।

কিন্তু ব্যাপারটি রেফারি সত্যিই বুঝে উঠতে পারেননি। পরে টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা যায়, গোলটি করার সময় ম্যারাডোনা হাত ব্যবহার করেন। ম্যারাডোনা পরে, এটি স্বীকার করে নিয়ে ‘হ্যান্ড অব গড’ বলে অভিহিত করেন।

এই বিতর্কিত গোলের পর আরেক অবিশ্বাস্য গোলের সাক্ষী হয় দর্শকরা। বিতর্কিত গোলের ঠিক চার মিনিট পরেই দ্বিতীয় গোল করেন এই আর্জেন্টাইন তারকা। যে গোলকে পরে ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত করে।

বিশ্বকাপ ১৯৯০: আর্জেন্টিনা ০-১ ক্যামেরুন

আগের আসরে দিয়েগো মারাদোনার নৈপুণ্যে বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনা ইতালিতে পাড়ি জমায় শিরোপা ধরে রাখতে। মিলানের সান সিরোয় উদ্বোধনী ম্যাচে তাদের সামনে ক্যামেরুন, তার আগে কেবল একবারই বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল দলটির। আফ্রিকার দেশটির বিপক্ষে মারাদোনারা সহজে জিতবে বলেই ধারণা করেছিল সবাই।

কিন্তু মাঠের লড়াইয়ে পাল্টে যায় হিসাব। প্রথমার্ধ কাটে গোলশূন্য স্কোরলাইনে। ৬১তম মিনিটে লাল কার্ডের খাঁড়ায় একজনকে হারিয়ে ফেলে ক্যামেরুন। পাঁচ মিনিট পর তারাই এগিয়ে যায়। বাকি সময়ে যা আর শোধ করতে পারেনি আর্জেন্টিনা। শেষ দিকে ক্যামেরুন ৯ জনের দলে পরিণত হলেও জয়োল্লাসে মাঠ ছাড়ে তারা।‘অদম্য সিংহ’ নামে পরিচিত ক্যামেরুন সেবার একের পর এক চমক জাগিয়ে পৌঁছে যায় কোয়ার্টার-ফাইনালে। সেখানে তারা হেরে যায় ইংল্যান্ডের কাছে।

শুরুর ওই ধাক্কা সামলে গ্রুপের তৃতীয় হয়ে নকআউট পর্বে ওঠা আর্জেন্টিনা শেষ পর্যন্ত উঠে যায় ফাইনালে। সেখানে তারা হারে তখনকার পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে, যাদের হারিয়েই চার বছর আগে তারা জিতেছিল বিশ্বকাপ, দ্বিতীয়বারের মতো।

ইতালির ওই আসরের পর ক্যামেরুন বিশ্বকাপে খেলেছে আরও পাঁচবার। একবারও তারা পার হতে পারেনি গ্রুপ পর্বের বৈতরণী।

বিশ্বকাপ ২০১৪: জার্মানি ৭- ব্রাজিল ১

আর এক ধাপ পেরোলেই নিজেদের আঙ্গিনায় বিশ্বকাপ ফাইনাল! এর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কিছু হতে পারে না। ব্রাজিলের সামনেও সেদিন এসেছিল এই সুযোগ। প্রতিপক্ষ জার্মানি। যদিও দলের প্রাণভোমরা নেইমার এবং অধিনায়ক থিয়াগো সিলভাকে ছাড়াই খেলতে নামে ব্রাজিল। তবুও তাঁদের সমর্থরা মাঠে এসেছিলেন দারুণ কিছুর প্রত্যাশা নিয়ে। প্রথম ১০ মিনিট দু'দলই ছন্নছাড়া ফুটবল খেলে। এরপরই কর্নার থেকে টমাস মুলারের গোল যেন বাঁধ ভেঙ্গে দেয়।

এরপর ২৩ মিনিটে মিরোস্লাভ ক্লোসার ইতিহাস গড়া গোল (বিশ্বকাপে এক খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বেশি গোল) থেকে ২৯ মিনিটে সামি খেদিরার গোল। এই ৬ মিনিটে যেন সুনামি বয়ে যায় ব্রাজিলের উপর দিয়ে। এই সময়ের মধ্যেই গোল হয় ৪টি! অর্থাৎ ৩০ মিনিটেই জার্মানি এগিয়ে যায় ৫-০ গোলে! এরপর দ্বিতীয়ার্ধে আরো দু'টি গোল করে জার্মানরা। ম্যাচের ৯০ মিনিটে অস্কারের গোল ব্রাজিলিয়ানদের কষ্ট আরো বাড়িয়েছিল কেবল। ১৯৫০ এর মারাকানাজোর পর আরেকবার নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ থেকে কান্না নিয়ে বিদায় নেয় ব্রাজিল। যা ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে বাজে পরাজয়।

তবে এই ম্যাচটির প্রেক্ষাপট অন্য ম্যাচগুলোর মতো নয়। সেমিফাইনালের মতো জায়গায় জিততে পারে যে কেউ। কিন্তু ম্যাচের স্কোরলাইনই এটিকে সেরা অঘটনের তালিকায় রাখতে বাধ্য করেছে।