স্পর্ধিত উনিশ পেরিয়ে পরিণত বিশে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট!
শুভ জন্মদিন বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট!
আজ ১০ নভেম্বর। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় তারিখ এটি। ২০০০ সালের এক স্নিগ্ধ সকালে টেস্ট ক্রিকেট পরিবারের দশম সদস্য হয়েছিল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম সেই ইতিহাসের সাক্ষী।
তারপর সময় গড়িয়েছে অনেক। মাঝে পেরিয়ে গেছে ১৯ বছর। সেই স্পর্ধিত উনিশ পেরিয়ে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট আজ পা রাখছে পরিণত বিশে। উনিশকে বলা হয় কৈশোরের শেষ বছর। যা ভুল করার সব করে নাও ওটুকু সময়টায়। বয়সের বিশ যখন শুরু, তখনই শুরু অনেক হিসেব-নিকেষ আর ভুল ধরার সময়। এই সময়ের ভুল দেখলে আশপাশের প্রায় সবাই ভ্রু কুঁচকায়-‘ঢং, এতো বয়স হলো, এখনো শুরুর ভুল কেন বাপু?’
পরিণত হওয়ার উদ্দাম আনন্দ আছে। তবে এই সময়ের লড়াইয়ে হঠাৎ করে ‘একা’ হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কাও আছে। এই সময় পুরো পৃথিবী যেন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠে! এমন সময়ের লড়াইয়ে জিততে না পারলে খুব অল্পতেই রায় চলে আসে-ওকে দিয়ে হবে না!
বিশ বছরের সেই ‘বিষময় বয়সে’ আজ পা রাখল বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট। কঠিন এই সময়কে পার করার আপাত দুটো উপায়। হয় পুরো পৃথিবীর কাছে নিজেকে ‘বিস্ময়’ করে তোলা। নয়তো বিষের ক্ষারকে নিজেই ক্ষয় হতে শুরু করা!
সন্দেহ নেই, ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের জন্য অন্য এক লড়াইয়ে জেতার সময়ক্ষণ শুরুর ঘন্টা বাজল। আর কি আশ্চর্য, ১৯ বছর আগের সেই নভেম্বরের ক্রিকেটীয় উন্মাদনা, আনন্দ আরেকবার ফিরে আসছে ২০১৯ এর নভেম্বরের হেমন্তের দিনেও।
সেবার ঢাকা। এবার কলকাতা! দুটোই বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের প্রিয় স্থান। অবাক কাণ্ড, প্রতিপক্ষ সেই একই; বাংলাদেশ বনাম ভারত!
সৌরভ গাঙ্গুলির জন্য একটা বিশেষ ধন্যবাদ বরাদ্দ রাখতেই পারে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। বিশে পা রাখা বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের জন্মদিনের মাসকে আরেকবার স্মরণীয় করে রাখার উপলক্ষ্য তৈরির জন্য। ১৪ নভেম্বর ইন্দোরে ভারত-বাংলাদেশ সিরিজের প্রথম টেস্টে খেলবে। আর দ্বিতীয় এবং শেষ টেস্টে মাঠে নামবে ২২ নভেম্বর। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সের সেই টেস্ট ম্যাচকে অন্য এক আমেজ দেওয়ার জন্য ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বর্তমান সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি যে আয়োজন ও মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেটা বাংলাদেশের ক্রিকেট মহলকে নস্টালজিক করে তুলতে যথেষ্ট।
২২ নভেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভারত-বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে দিনরাতের। প্রথমবারের মতো গোলাপি বলে টেস্ট খেলবে উভয় দল। টেস্ট ম্যাচের উদ্বোধনীতে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটু মনে করিয়ে দেই, ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেকের উদ্বোধনও করেছিলেন শেখ হাসিনা।
১৯ বছর আগের সেই টেস্টে প্রথমবারের মতো ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে টস করতে নামেন সৌরভ গাঙ্গুলি। বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন নাঈমুর রহমান দুর্জয়। টেস্ট ক্রিকেটে দুই বাঙ্গালির টস করার সেটাই প্রথম ঘটনা। ১৯ বছর পরের আরেক নভেম্বরে দু’দল যখন আরেকবার টেস্ট খেলতে নামছে, তখনো এই দুইজন থাকছেন। অবশ্য একটা অন্য ভঙ্গিতে, ভিন্ন চেয়ারে। সৌরভ গাঙ্গুলি এখন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান অধিকর্তা। নাঈমুর রহমান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক।
কি আশ্চর্য! সেদিনের দুই অধিনায়কই আজ নিজ দেশের ক্রিকেট প্রশাসকের চেয়ারে।
ইতিহাসের পুনারাবৃত্তি হয় তাহলে, ক্রিকেটেও!
তবে বাংলাদেশের ফেলে আসা ১৯ বছরের টেস্ট ইতিহাস খুব একটা সুখকর কিছু নয়। টানা হার দেখা, হোঁচট খাওয়া, সমস্যা- সংগ্রাম এবং খানিকটা আনন্দময় সময়; যোগফলটা এমনই।
টেস্ট ক্রিকেটের উন্নতির প্রধান শর্তই হলো দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট কাঠামো এবং এর গুনগত মানের উন্নয়ন। বাস্তবতা জানাচ্ছে এই ১৯ বছরে এখনো সেই ধাপ পেরুনোর প্রথম সিঁড়িতেই বাংলাদেশ! বছরে মাত্র ছয়টা প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে টেস্ট ক্রিকেটার খোঁজার স্বপ্নটা, বাসার ছাদে মই লাগিয়ে চাঁদে যাওয়ার মতোই সিদ্ধান্ত!
এই ১৯ বছরে আফগানিস্তানের মতো টেস্ট ক্রিকেটে নবীন দলের কাছে হার যেমন দেখেছে বাংলাদেশ, আবার ঠিক তেমন শ্রীলঙ্কার মাটিতে বলে কয়ে তাদের টেস্টে হারিয়েও দিতে পেরেছে বাংলাদেশ। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিমানকে হারিয়েছে। মোহাম্মদ আশরাফুলের কৃতিত্ব দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। লর্ডস টেস্টে তামিম ইকবালের সেঞ্চুরি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। র্যাঙ্কিংয়ে সাকিব আল হাসান শাসন করেছেন ক্রিকেট বিশ্ব একক কৃতিত্বে। শতাব্দি পুরানো টেস্ট ক্রিকেটের বেশ কিছু কৃতিত্বপূর্ণ রেকর্ড বাংলাদেশের নামের পাশে।
দুর্বল পরিকাঠামো। পরিকল্পনায় দুরদর্শিতার অভাব। পরিচালনায় পেশাদারিত্বের সঙ্কট। নিজস্ব ক্রিকেটীয় সম্পদ, মস্তিষ্ক এবং তাদের শক্তি-সামর্থ্যরে ওপর আস্থাহীনতা। দ্রুত ছাঁটাই, বেশি বাছাই। অধিনায়কের সীমিত ক্ষমতা। এতসব অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও ১১৫ টেস্টের ১৩টিতে জয়-সন্তোষজনক না হলেও গলা ছেড়ে কান্নারও কিছু নেই!
আজ বিশে পা রাখা বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট সামনের সময়টায় জুড়ে বিশ্বকে ‘বিস্মিত’ করুক, সাফল্যের আলোয়। শুভ কামনা।