ডিজিটাল বাংলাদেশ, গ্রহীতার সঙ্গে সেবা দাতাও স্বস্তিতে

ছবি: সংগৃহীত
ডিজিটাল বাংলাদেশ শুধু সেবা গ্রহীতাকে প্রশান্তি দেয় নি, সেবা দাতাকেও স্বস্তি এনে দিয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে একজন কর্মী এখন ৮ জনের সমান সেবা দিতে পারছেন।
এমনটাই দাবি করেছেন রাজশাহীর পবা উপজেলার হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব গোলাম সাকলায়েন।
দীর্ঘদিন ধরে সচিব পদে থাকা গোলাম সাকলায়েন বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি এখন যে কাজগুলো করছি, যদি আগের মতো এনালগ সিস্টেম থাকতো তাহলে এই সেবা দিতে ৮ জন স্টাফ প্রয়োজন হতো। সেই কাজটি আমি একাই স্বস্তির সঙ্গে করতে পারছি।
এইতো ১০ বছর আগেও মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো, তারপরও কাজ শেষ করার কঠিন হতো। এখন যখন কার কাজ তখনেই শেষ করে ফেলতে পারছি। আগে দেখা যেতো অনেক সময় ফাইল খুঁজে পেতে হয়রান হতে হতো। এতে সেবা গ্রহীতা দুর্ভোগের শিকার হতেন, আবার সেবা দাতাকেও পেরেশান হতে হতো। এখন ফাইল খোঁজার কোনো বালাই নেই, পিন কোর্ড দিয়ে ঢুকে ঝটপট সব সমাধা করে দিতে পারছি।
২০০৬ সালের দিকের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, তৎকালীন ডিসি এসেছিলেন আমার ইউনিয়ন পরিষদ পরিদর্শনে। আমাকে খাতাপত্র আনতে বললেন, তখন টেবিলের উপর সবগুলো খাতার জায়গা হচ্ছিল না। ডিসি স্যার তখন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এতো খাতা তুমি একা সামলাও কি করে। পাশে বসা ইউএনওকে বললেন, তোমার অফিসেওতো এতো খাতা টানতে হয় না।
ইউনিয়ন পরিষদে আরেকটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করে গোলাম সাকলায়েন। তা হচ্ছে, ডিজিটালাইজড হওয়ার আগে ইউনিয়ন পরিষদ ছিল চেয়ারম্যানদের পকেটে। হিসেব-পাতি সবই চলতো চেয়ারম্যানের খেয়াল খুশির উপর, বছর শেষে গোজামিল দিয়ে হিসেব মেলানো হতো। এরপর খাতা আবার চেয়ারম্যানের ড্রয়ারে চলে যেতো।
কিন্তু এখন সবকিছু হচ্ছে স্বচ্ছতার সঙ্গে, আয় বেড়েছে কয়েকগুণ। গোজামিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আগে প্রায় শুনতে হতো গ্রাম পুলিশদের বেতন বছরের পর বছর বকেয়া পড়ে রয়েছে। এখন কিন্তু সে সব খবর আর কানে আসে না। আয়ে স্বচ্ছতার কারণে এই পরিবর্তনটি এসেছে বলে মনে করেন গোলাম সাকলায়েন। যার পুরো ক্রেডিট বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
বয়সগত কারণে প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমার কাছে তা মনে হয় না। ২০০৬ সালে ৯ দিনের একটি ট্রেনিং নিয়েছিলাম, এরপর আর পেছনে ফিলে তাকাতে হয় নি।
তিনি বলেন, আগে অনেক ছোটো খাটো কাজের জন্য জেলা সদর রাজশাহীতে যেতে হতো। এখনই ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে এই সেবা পাওয়া যাচ্ছে। সরকার এখানে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড নেট সংযোগ দিয়েছে। উদ্যোক্তাকে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে পরিষদ কমপ্লেক্সে। এখানে সাশ্রয়ী মাসুলে সেবা নিতে পারছেন গ্রামীন জনপদের লোকজন। সারাদেশে ৮ হাজারটি এমন ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে সর্বোচ্চ ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে গেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এই দুরত্ব কমিয়ে ২ কিলোমিটার করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। অর্থাৎ ২০২৫ সালে প্রত্যেক নাগরিক তার বাড়ি থেকে ২ কিলোমিটারের মধ্যে ডিজিটাল সেবার উৎস পেয়ে যাবেন।
অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন ও ফি জমাদান, জমির পর্চা উত্তোলন, অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান, ই-নামজারি আবেদন ও ফি প্রদান, অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, যাচাই ও জাতীয় পরিচয়পত্রের অনলাইন কপি প্রদান, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, চাকুরীর আবেদন, অনলাইনে বাস, ট্রেন ও বিমানের টিকেট ক্রয় সেবা, এজেন্ট ব্যাংকিং-গ্রাহকের একাউন্ট খোলা, টাকা জমাদান ও উত্তোলন, বিদেশ হতে প্রেরিত রেমিট্যান্স উত্তোলন, অনলাইনে পুলিশ কিলিয়ারেন্স আবেদন ও ফি জমাদান বিদ্যুত বিল জমাদান, অনলাইনে বিদ্যুৎ সংযোগ/মিটারের জন্য অনলাইন আবেদন, অনলাইনে পণ্য ক্রয় সেবা, বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল প্রদান, ভিসা আবেদন, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ও চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান, জন্ম ও মৃত্যু সনদ,অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স লার্নার আবেদন ও অনলাইনে টেলিমেডিসিন সেবাসহ বেশ কিছু সেবা প্রদান করা হচ্ছে এসব সেন্টার থেকে।
এক সময় এসব সেবা পেতে হলে জেলা সদরে ধর্না দিতে হতো। একদিকে যেমন সময় সাপেক্ষ ছিল, অন্যদিকে পয়সাও গুণতে হতো বেশি। সেই সেবাগুলো এখন মানুষ দোর গোড়ায় পেয়ে যাচ্ছেন। নাগরিক সেবা যেমন বেড়েছে তেমনি সেবা দাতারাও আছেন মহা আনন্দে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। তখন অনেকে একে নির্বাচনী স্ট্যান্ডবাজি বলে মন্তব্য করেছিলেন। আবার কেউ কেউ নানা রকম টিপ্পনী কেটেছিলেন। ১৩ বছর পরে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তবতার নাম। যা ছাড়া জীবন অচল বলা চলে। ইউনিয়ন পর্যায়ে উচ্চগতির নেটের কারণে গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও এখন একেকজন বিশ্ব পরিমন্ডলের গর্বিত অংশীদার। অনেকে ঘরে বসেই কাড়ি কাড়ি ডলার আয় করছেন। যা চাকরি করে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। অনেকে চাকরি না খুজে ফ্রিল্যান্সারের খাতার নাম লেখাচ্ছেন। তাদের অনেকেই প্রথম ধাপ পেরিয়ে সফল উদ্যোক্তার কাতারে পৌঁছে গেছেন। যাদের আয়ের অংক চমকে যাওয়ার মতোই। প্রথম চোটে বিশ্বাস করার মতো তো নয়ই।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বার্তা২৪.কমকে বলেন, একজন ফ্রিল্যান্সারের অ্যাকাউন্টে হঠাৎ ৩ কোটি এলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নড়চড়ে বসে। বিষয়টি আমার কাছে চলে আসে, আমরা যাচাই করে দেখেছি ছেলেটি গেমস ডেভেলপ করে এই টাকা আয় করেছে। এ রকম হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সার রয়েছে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
যশোর আইটির সিইও রাকিব হাসান ফ্রিল্যান্সার থেকে এখন সফল উদ্যোক্তা। ৩১ বছর বয়সী এই উদ্যোক্তা ৩৬ বছর বয়সে ব্যবসা থেকে অবসর নিতে চান। যে জমিয়েছেন, আর যা চেইন তৈরি করে রেখেছেন অবশিষ্ট জীবন বসে খেলেও তার সংকট হবে না বলে মনে করছেন। রাজশাহীর মতো জায়গায় তৈরি হয়েছে খাইরুল আলমের মতো মাল্টি-মিলিয়নিয়ার। রাজশাহীতে হয়তো কারখানার গমগম আওয়াজ নেই। কিন্তু নিরব বিপ্লব শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। পরিবেশ দূষণ ছাড়াই ভিন্নরূপে আর্বিভূত হতে চলেছে প্রমত্তা পদ্মার পাড়ের ঐতিহ্যবাহী এই নগরটি।