প্রশান্ত পশ্চিম

  • মাহমুদ হাফিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

পর্ব-২

ইস্তাম্বুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিশালত্ব দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। নবনির্মিত, ঝকঝকে, তকতকে। মুহূর্তে সহস্র যাত্রী একজায়গায় মিলিত হয়ে দূরগ্রামী হচ্ছে। বছরে এই বিমানবন্দরের ধারণক্ষমতা নাকি ২০ কোটি বলে শুনেছি। ইউরোপের বহু হাওয়াই জাহাজ কোম্পানির ব্যবসা পরিচালনার কেন্দ্র এখন এই বন্দর।

বিজ্ঞাপন

চলন্ত সিঁড়িতে ট্রান্সফার টার্মিনালের দিকে এগিয়ে যাই। এ যাত্রায় ইস্তাম্বুল আমাদের গন্তব্য না। চারঘণ্টা লেওভার শেষে উড়াল দেবো মার্কিন মুলুক মুখো। চলন্ত সিঁড়ির শেষ মাথায় লিফট ও সিঁড়ি। দোতলা থেকে তিনতলায় উঠতেই বৃত্তাকার বিশাল প্রাঙ্গণ। এখানে বিশাল আকারের ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে ঘাড় ঘুরিয়ে ট্রান্সফারযাত্রী পরবর্তী ফ্লাইটের গেট নম্বর জেনে নিচ্ছে। চত্বর ঘিরে চারপাশে আলো ঝলমল বিপনী। তাতে বহুবর্ণিল পোশাক, সুগন্ধী, গহনা আর সৌখিন সামগ্রীর বিপুল সম্ভার পকেট উজাড়ের হাতছানি দিচ্ছে। সেসব হাতছানিকে উপেক্ষা করে আমি বরং পকেটে হাতড়ে ফিরছি প্রায়োরিটি পাস কার্ড।

তুসুকে বললাম, এয়ারপোর্টের ওয়াইফাই সুবিধা নিয়ে লাউঞ্জ কোন দিকে তার হদিস করতে। তাতে সুবিধা করতে না পেরে সামনে দাঁড়ানো ইউনিফর্মধারী ফর্সা দীর্ঘাঙ্গিনীর কাছে জিজ্ঞেস করি। সে দেখিয়ে দেয়- সামনে এগিয়ে বাঁ দিকে এসকেলেটর। ওপরে উঠলেই ডানে ইস্তাম্বুল গ্রান্ড এয়ারপোর্ট-আইজিএ লাউঞ্জ। 

বিজ্ঞাপন
আইজি এ লাউঞ্জের দেয়াল মরিচবাতিসজ্জিত

লাউঞ্জে যেতে যেতে আমার স্মরণঅলিন্দে জাবর কাটে পূর্বরাতে হাওয়াই জাহাজে ভেসে আসার সম্পূর্ণরঙিন উড়ালচিত্র। ঢাকা থেকে টেকঅফ করেই টার্কিশএয়ারের সুপরিসর এয়ারবাসটি চলে যায় পশ্চিমবঙ্গের আকাশে। জলি উইন্ডো আসনে। আমি তার দিকে ঝুঁকে পড়ে নিচের আলোকমালায় উদ্ভাসিত কলকাতা, হলদিয়া, বকখালি দেখি। মনে ভেসে ওঠে বিশ্বপর্যটক অমরেন্দ্র চক্রবর্তী, বৃক্ষবন্ধু কমল চক্রবর্তী, ‘তুই লালপাহাড়ের দেশে যা’খ্যাত অরুণ চক্রবর্তী, কবি বন্ধু সৌমিত বসুসহ অংসখ্য বন্ধুসুহৃদের মুখ। যে আকাশ দিয়ে উড়ছি, এর নিচে বসবাসরত এই বন্ধুস্বজনরা কি এখন ঘুমিয়ে? আসনলাগোয়া মনিটরে স্ক্রিনটাচ বাটন চেপে যাত্রাপথের মানচিত্র বের করি। দেখি কানপুরের ওপর দিয়ে জয়পুরকে বাঁয়ে আর অমৃতসরকে ডানে রাখছে উড়োজাহাজ। মাটি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট বিচ্ছিন্ন থাকলেও যেন অপূর্ব যোগাযোগ মৃত্তিকার সঙ্গে। যে মৃত্তিকা একদা মাতৃগর্ভ থেকে আশ্রয় দিয়েছিল নিজবুকে।

ছুটে চলেছি ইসলামবাদ হয়ে কাবুলের দিকে। সৈয়দ মুজতবা আলী, মঈনুস সুলতানের প্রিয় কাবুল। তালেবানরা কি অলরেডি ক্ষমতায়? সেখানে এখন যে অস্থিরতা, এর অবসান হবে কবে? তালেবানের উত্থান দুনিয়াকে কোন বার্তা দিচ্ছে? এসব জিজ্ঞাসা মনে এই জন্য এলো যে, টার্কিশ এয়ালাইন্সে তুরস্ক হয়ে যাচ্ছি আমেরিকায়। আমেরিকা আর তুরস্ক অশান্ত কাবুলে বড় প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র কাবুল ছাড়ছে, কাবুলের  সহযোগিতায় এগুচ্ছে তুরস্ক। আমার মতো নিরেট ভ্রামণিকের মাথায় রাজনীতি- ভূরাজনীতি ঢোকে না। এতোটুকু বুঝি, এই পৃথিবী বড় জটিল এক জায়গা।

পাখিচোখ সোজা নিচে ছাড়াও দূরের শহরকে চোখের ওপর প্রতিভাত করে।  মানচিত্র যাত্রাপথের তিনশ কিলোমিটারের মধ্যকার শহরগুলোর নাম দেখাতে থাকে। তাই এই পথে নানা শহরের নাম আসছে। মজার ব্যাপার, ঢাকা থেকে তুরস্কের পথে এয়ারলাইন্সটি ভারতছাড়া মুসলিমপ্রধান দেশের ওপরকার রুট বেছে নিয়েছে। ভারতের পর পাড়ি দিচ্ছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান।

ইতোমধ্যে দীর্ঘাঙ্গিনী তুর্কিসুন্দরী ডিনারের পাট চুকিয়ে আলো নিভিয়ে দিয়েছে। চারদিক আসছে নাকডাকার মজার মিহিন শব্দ। চিকন সুগন্ধিচালের বাটার রাইস, চিকেন, সালাদ আর কালোজাম খেয়ে আমি নির্ঘুমচোখে দেখে চলেছি ভূরাজনীতির সংঘাতময় এই উড়োজাহাজের রুট। যেখান থেকে সিরিয়া, বাগদাদ কিংবা ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিন খুব বেশি দূরে নয়।

আইজিএ লাউঞ্জ

বিমান এখন উড়ছে ইরানের ওপর। ‘শাহনামা’র কবি ফেরদৌসী, কবি হাফিজ ও কবি রুমির কথা মনে ভেসে ওঠে আমার। মনে ভেসে ওঠে সেই বিখ্যাত শায়ের ‘আগার আঁ তুর্কে শীরাজী বদস্ত আ রাদ দিলে মারা/ বখালে হিন্দওয়াশ বখশাম সমরকন্দ ও বোখারা রা’ (সিরাজ শহরে যে তুর্কিসুন্দরী করেছে  হৃদয়হরণ/ ফিরিয়ে তা দিলে তা করবো তাকে সমরকন্দ ও বোখারার উপহারে বরণ)। মনে পড়ে,  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পারস্য ভ্রমণের কথা। তার পারস্য ভ্রমণগদ্য পড়ে হয়েছি একদা উতলা। সে দেশের ওপর দিয়ে এখন উড়ে চলেছি। তেহরান বাঁয়ে, তুর্কমেনিস্তান ডানে দেখা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে কাস্পিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজ উড়তে থাকে আজারবাইজানের বাকু নগরীর দিকে। রাতের অন্ধকারে নিচে তাকিয়ে মানচিত্রের সঙ্গে শহরের আলোকমালা মেলাতে থাকি। চোখে ঘুম নেই। সাগর পাড়ি দেয়ার পর বাকু শহরের আলোকমালা। ডানে জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসি, বামে আর্মেনিয়া ভেসে ওঠে মানচিত্রে। সিভাস শহরের ওপর দিয়ে তার্কিশ এয়ার প্রবেশ করে নিজ জন্মভূমে। দীর্ঘপথ পাড়ির পর উড়োজাহাজ আঙ্কারাকে বাম পাশ কাটিয়ে যেতে থাকে। আঙ্কারায় এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নান। পেশায় গম্ভীর কূটনীতিক, নেশায় সংগঠনপ্রিয়-সংস্কৃতিপ্রাণ রাষ্ট্রদূত আমাদের বন্ধুজন। তার কথা ভাবতে ভাবতেই তুরস্কের পর্বত ও সাগরময় অনেক শহর পেরিয়ে জাহাজ কৃষ্ণসাগর ও মারামার ওপর থিতু হয়ে চক্কর দিতে থাকে। বসফরাসকে আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরার পর শহর থেকে দূরে বিমানবন্দরে নামে।

আই জি এ লাউঞ্জের গেটমুখ পৌঁছে দেখি একযুগোল যুবক-যুবতী সামলাচ্ছে বড়সড় লাউঞ্জের রিসেপশন। একজনের পর আমার পালা এলে ‘গুনাইদেন’ বা ‘শুভসকাল’ অভ্যর্থনা পেলাম। ভুলভাল উচ্চারণে বিপরীতে বললাম, ‘তেসিকুল্লের এদেরিম’। সফরসঙ্গী কনিষ্ঠ পুত্র তুসু ঢাকার তুর্কিশ হোপ স্কুলে পড়েছে। কয়েকবছর তুর্কি ভাষাটির কোর্স করতে হয়েছে তাকে। সে সুবাদে আমারও দুয়েকটি তুর্কি শব্দ- বাক্য জানা। তা এস্তেমাল করার মওকা পেয়ে খুশিই হলাম। প্রায়োরিটি লাউঞ্জের এক্সেস ওপেন করে ওয়াইফাই আইডি আর পাসওয়ার্ড হাতে দিয়ে সহাস্যবদন যুবক যুবতী লাউঞ্জে স্বাগত জানালো আমাদের।  বোর্ডিং পাসটি স্বয়ংক্রিয় গেটের বারকোড রিডারে ছোঁয়াতেই গেটখুলে গেলো। ভেতরে সুলতান সোলেমান স্টাইলের রাজকীয় আতিথ্যরাজ্যে প্রবেশ হলো আমাদের।

বিমান চলাচলের ঢাউস বিলবোর্ড

প্রযুক্তিযুগে আধুনিক ভ্রামণিকের ভ্রমণের এই এক মজা। ইবনে বতুতার মতো দিনমান ক্লান্তিকর পদব্রজ পরিভ্রমণই শুধু নেই। এখানে আছে ভ্রমণক্লান্তির পরই ঘরোয়া প্রশান্তি। পকেটের পাস বিশ্বজুড়ে বিমানপোতগুলোতে রেখে দিয়েছে বাঁধা সেবিকার বহুমাত্রিক শুশ্রুষা-যার নাম প্রায়োরিটি লাউঞ্জ। সেখানে খানাপিনা, হোতনা, বসনা, গল্প করনার মতো সব এন্তেজামই খাসা, পাঁচতারকামানের।

আরও পড়ুন: প্রশান্ত পশ্চিম, পর্ব-১

আইজিএ’র লম্বা করিডোর পেরিয়ে বাম হাতে প্রথমে ওয়েটিং লাউঞ্জ। অর্ধবৃত্তাকার টানা সোফাসহ সামনে জোড়ায় জোড়ায় সোফা। নিশিজাগা রাত্রিদের অনেকে গা এলিয়ে ঝিমু্চ্ছে। উল্টোদিকে লাগেজ রাখার সেফবক্স। একটু সামনে ডানে বড় হলের একপাশে রেস্টুরেন্ট। জনা ত্রিশেক একসঙ্গে খানাপিনা করতে পারে এমন সংখ্যায় চেয়ার টেবিলসজ্জিত। রেস্তোরাঁর একদিকে ব্যুফে খাবারের লোভনীয় রকমারি আইটেম ক্ষুৎপিপাসাকাতর যাত্রীর জিহবায় আত্মাহুতি দিতে অপেক্ষমান। বিপরীতে দিকের দেয়াল মরিচবাতিসজ্জিত। অন্যপাশে বিশাল টানা বারান্দা থেকে নিচের বিপনীবাজারের বিশাল লাইভ ক্যানভাস। দোকানের বেচাকোনা, ফ্লাইট ধরতে বোচকাবুচকি নিয়ে যাত্রীদের হন্তদন্ত ছোটাছুটি চোখে পড়ে সে ক্যানভাসে দৃশ্যমান। এসব পেরিয়ে যতোই লাউঞ্জের  গভীরে যাই, ততোই আবিষ্কার করি নতুন নতুন সুবিধা। ভেতরে ডান পাশে বাথরুম-রেস্টরুম কমপ্লেক্স। নরনারীর আলাদা বাথরুম, গোসলখানা, ওজুখানা। রেস্টুরুম বা বাথরুম নাম শুনলে মনে যে চিত্রকল্পের উদয় হয়, এটি তার উল্টো। পুরো লাউঞ্জের বাথরুমই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। পরিচ্ছন্ন, সুগন্ধিময় ও দৃষ্টিনন্দন বাথরুমে বহুঘন্টা পার করে দেয়া যায়। সবচেয়ে আকর্ষণ এর মাল্টিফেইথ প্রেয়ার রুম। ওজুখানাসহ গোলাকৃতি নামাজঘর যেমন আছে, তেমনি আছে প্রার্থনা ও পড়ার ব্যবস্থা। এই রেস্টরুম পেরিয়ে বাঁয়ে উন্মুক্ত ক্যাফেতে আবেশ ছড়ানোর পানীয়ের ব্যবস্থা। ওয়েটাররা অপেক্ষমান আদেশের অপেক্ষায়।

পছন্দমতো জায়গা বেছে নিতে সব হল ঘুরে দেখি। নিশিজাগা যাত্রীরা বিশ্রামরত। যে যেখানে পেরেছে ঘুমিয়ে আছে স্বপ্নের জগতে। পছন্দমতো চারটি সিঙ্গেল সোফা ও গোলাকার সেন্টার টেবিলে দেখে আমরা হাতের লাগেজপত্র নামাই। হাতমুখ ধুয়ে আসি। থরে থরে সজ্জিত তুর্কিশ ক্যুইজিন থেকে নানারকম খাবার নিয়ে আরাম করে খাই। রাইস স্যুপ, ব্রেড, হানি, জেলি, স্যামন সালাদ এসব। 

আইজিএ লাউঞ্জের একাংশ

চারদিকের পরিবেশ ঘুমানোর এন্তার এন্তেজাম। মাত্র চারঘন্টা পরই বোর্ডিংগেটে চলে যেতে হবে বলে ঘুমাতে চাচ্ছি না। সফরসঙ্গী জলি ও তুসুকে ঘুমানোর সুযোগ দিয়ে আমি জেগে বইয়ে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করি। কিছুক্ষণ পর ঘুমজড়ানো চোখেই জলি উঠে বসে-

‘তুসু থাক, চলো নিচে ঘুরি আসি’।

সে বোধ হয় কিছু কিনতে চায়। ডিউটি ফ্রি’তে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে তেমন কিছুই কেনার পাই না বা কিনি না। ফিরে আসি।

আমেরিকার পশ্চিম উপকূলশহর সানফ্রানসিস্কোর উদ্দেশে আমাদের পরের ফ্লাইট টি কে ২৮৯ ছেড়ে যাবে সকাল আটটা পঁচিশে। ঘণ্টাকাল আগেই আইজিএ লাউঞ্জের ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে বোর্ডিংগেটের নম্বর ভেসে ওঠে-ডি ১১। লাউঞ্জ থেকে এর দূ্রত্ব আধকিলোমিটারের কম নয়। তাই সোলেমানী আতিথ্যের পাট চুকিয়ে আমরা হাতব্যাগ গুছিয়ে সেদিকে রওনা দেই। আমেরিকার ফ্লাইট। আমাদের পাসপোর্টে  মাহমুদ আর মাহমুদ, আমরা বিশ্বাসী মুসলিম। নিরাপত্তার তোড়জোড় একটু বেশিই।