প্রশান্ত পশ্চিম

  • মাহমুদ হাফিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

পর্ব-৬

ক্রিস্টাল মাউন্টেনের সাত হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে আকস্মিক আমার গা কাঁপছে। সামিট হাউসের ইলিশিয়ান ডেস্ক থেকে ব্লুবেরি সাইডার কিনে সামনের আকাশরেখায় পাতা টেবিলসারির একটা জুড়ে বসেছি। অন্য টেবিলেগুলোতে নানাদেশের পাহাড়প্রেমী পর্যটকের খানাপিনার টুংটাং। আমার সঙ্গীরা তখনও স্যান্ডউইচ ও বিফ র‍্যাপ সংগ্রহের লাইনে। একসঙ্গে আটাত্তর ডলার দাম চুকানো হলেও সাইডার ক্যানটি কাউন্টার থেকেই হাতে পেয়েছি, অন্য আইটেম বানিয়ে দেয়া হবে বলে সময়সাপেক্ষ। আমার তর সইছে না। তবিয়ত ঠিক রাখতে দ্রুত রক্তস্রোতে কিছু চালান করে দিতে হবে।  ক্যানটি ডাবল সাইজ বিয়ারের মতো, মাত্রাও সাত শতাংশের মতো। পাহাড়শীর্ষে জীবন বাঁচাতে আর কিছু করার নেই। ক্যানটি খুলে যখন চুমুক দিতে যাবো, তখনই কুট্টুস শব্দ করে এক পাহাড়ি পাখি এসে টেবিলে হাজির। একদম হাতের কাছে। আমাদের দোয়েলের চেয়ে ছোট, চড়ুইয়ের চেয়ে বড় ভাই। ভদ্রগোছের শান্তপাখি। এখানে নাম উইলো ফ্লাইকাচার। মনুষ্যভীতিতে তোয়াক্কা না করে আদুরে ভঙ্গিতে ফুরুৎ করে উড়ে কাছে আসায় ভাবি খাবারের খোঁজে হন্যে সে। ন্যাটজিও টের পেলে এতো উচ্চতা বাস করার পাখির ওপর প্রামাণ্যচিত্র বানাতো। এতোটা উচ্চতায় আমার মতো তার গাও কাঁপছে কিনা কে জানে!

বিজ্ঞাপন
হেঁটে চলেছি মাউন্ড রেইনিয়ারের দিকে

ওয়ানটাইম গ্লাসে খানিকটা মিস্টি সাইডার ঢেলে পাখিকে  দিতে যাচ্ছি, এমন সময় পাশের নোটিশবোর্ডের দিকে শাহাদত আঙুল উঁচিয়ে সতর্ক করলো মধ্যবয়স্ক রেস্তোরা কর্মী। নোটিশে লেখা’ হিউম্যান ফুড ক্যান বি ডেডলি ফর হাই অলডিচ্যুড ক্রিটার্স, ডন্ট ফিড দেম, ইভেন ইফ দে বেগ’। কথা পরিস্কার। আমি পাত্র সরিয়ে সাইডার না ঢেলে  লম্বা একটা চুমুক দিই। বিয়ারের স্বাদ তিতা হলেও এই ব্লুবেরি সাইডার মিষ্টি। টাইটন সাইডার ওয়ার্কস কোম্পানি  ইয়াকিমা উপত্যকার নিজস্ব খামারের তাজা ফল থেকে তৈরি করেছে এই মহার্ঘ। গুনাগুন ও ফুডভ্যালুর কথা লেখা আছে ক্যানের গায়ে। কয়েক চুমুকে থাতস্থ হওয়ার পর আমি  পরিচ্ছন্নকর্মীর ওপর মনোযোগ দিই। ইতোমধ্যে পাখিটি ফুরুৎ করে উড়ে হাতের নাগালের মধ্যেই পাশের ঝাওগাছের ডালে বসেছে। আজন্ম অকর্তিত শ্রুশ্মুগুম্ফওলা মধ্যবয়স্ক রেস্তোরাকর্মী টকটকে ফর্সা ও নাদুসনুদুস চেহারার। যেসব পাহাড়প্রেমী প্রচুর টাকা খরচ করে গন্ডোলাচেপে বা পাহাড় বেয়ে  মাউন্টেন সামিটে পৌঁছেছে, তাদের কারও চেয়ে চেহারাসুরত তার কম নয়। এমনকি চোখেমুখে শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তি ও আভিজাত্যের চাপ। খাকি রঙের ইউনিফর্মধারী লোকটি বিশেষ ধরনের হাতানি দিয়ে টেবিলের  উচ্ছ্বিস্ট সরাচ্ছে। মনে হলো, সে এখানে গোয়েন্দাগিরি করছে, নয়তো পাহাড়প্রেমে বুঁদ হয়ে আমাদের মতো ঘুরতে এসে এই চাকরি যেচে রয়ে গেছে।  আমি মেলাতে পারি না। ভাবি, কতো রঙের মানুষ আছে এ জগতে!

ব্লুবেড়ি সাইডার

জনপ্রিয় লেখক ব্রাজিলিয়ান পাওলো কোয়েলহো’র তীর্থভ্রমণমূলক বেস্টসেলার ‘পিলগ্রিমেজ’ এর যে কপিটি মার্কিন মুলুকে এসে হাতে পেয়েছি, এর প্রচ্ছদে পুঞ্জপাহাড়ের সন্নিবেশ, ক্যাসেকডেময়। এর আগে সিয়াটলের ডাউনটাউনসহ নানা দ্রষ্টব্য আমাদের দেখা হয়ে যাওয়ায় সিয়াটলে আমাদের সাময়িকবাসের গৃহকর্তা পল ওয়াশিংটন স্টেটের বিভিন্ন ওয়ান্ডার ও পর্যটকপ্রিয় এলাকাগুলোতে নিয়ে যেতে যাওয়া শুরু করেছে। আমাদের সিয়াটল বাস ও পর্যটন যাতে আরামদায়ক,ভ্রমণপ্রিয়চোখে সুখকর হয়,সেজন্য  পল-জেরিন দম্পতির রাতের আরাম হারাম হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে আজকের লংড্রাইভ ক্রিস্টাল মাউন্টেন। পাওলো কোয়েলহোর পিলগ্রিমেজ এর প্রচ্ছদ সে আগ্রহকে উস্কে দেয়। আমি ত্বরিত সায় দিয়ে গাড়িতে উঠে বসি।  লিনউড এর বাসা থেকে রওয়ানা দিতে দিতে বেলা বারোটা। ক্রিস্টাল গন্তব্যে দুই, সোয়া দুইঘণ্টা লাগবে। আবহাওয়া সকাল থেকেই রৌদ্রকরোজ্জ্বল।

বিজ্ঞাপন
বহুদূর থেকে মাউন্ট রেইনিয়ার

লিনউড থেকে ডামসন রোড দিয়ে বেরিয়ে এই ড্রাইভ ৫২৪ ও ৫২৭ সড়ক ধরে ছুটে  চলে। ক্যানিয়ন পার্ককে বাঁয়ে রেখে বৃত্তাকার একটি চক্কর দিয়েই উঠে পড়ে  ফ্রি ওয়ে ফোর ও ফাইভে। এখানকার ড্রাইভে এই এক মজা। ফ্রিওয়েতে উঠলে থামার নাম নেই। এক্সিট দিয়ে আঞ্চলিক রাস্তায় নামার আগে শুধু ছুটে চলা। বিরতিহীন, উচ্চ গতিময় ফ্রিওয়েতে ড্রাইভের রোমাঞ্চই আলাদা। মার্কিনীরা দূরত্ব বোঝাতে মাইল-কিলোমিটারে না বলে ঘণ্টা মিনিটের সঙ্গে ড্রাইভ শব্দটি যোগ করে বলে। আমি ভোতো বাঙালি। মাপের ফিতায় দূর্তব না বললে মাথায় ঢোকে না আমার।  গুগলিং করে দেখছি, আমাদের যেতে হবে দেড়শ’ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে আমার জন্ম উপজেলা কুমারখালীর দূরত্বের সমান। আমরা যেখানে কমবেশি ছয় থেকে আটঘণ্টা ড্রাইভ করে যাতায়াত করি। অনেকটা পাহাড়ি সড়ক হওয়ার পরও এখানে দেখাচ্ছে, সোয়া দু’ঘণ্টা। কবি এখানেই নিরব। ঘণ্টা দুয়েক পর্বত আরোহণ শেষ করেও  এ ড্রাই্ভে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরা যাবে অনায়াসে। বহু দেশের মানুষ বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন কূটনীতির কট্টর সমালোচনা করলেও স্বপ্নের দেশ হিসাবে বিশ্বজুড়েই এর খ্যাতির কমতি নেই। সব দেশ থেকেই  স্বপ্নবাজ তরুণের গন্তব্য আমেরিকা।

গাড়ি ছুটছে একশ চল্লিশ কিলোমিটার গতিতে। ঘরের বাইরে যাচ্ছি, অথচ শুনতে মন চাইছে ঘরে ফেরার গান। এ সময় মার্কিন শিল্পী স্কাইলার গ্রে’র ‘টেল দ্য ওয়ার্ল্ড, আই এম কামিং হোম’ গানটি প্লেয়ারে চললে হলে মন্দ হতো না। অন্তত আইস শিল্পী আসগের এসনাইরসনের ‘গোয়িং হোম’। এমনই মন আমার, বিপরীতমুখী উপাদানে গড়া। নিজের সম্পর্কে নিজের  ট্যাগলাইন:’ বোহেমিয়ান ও ঘরকুনো, কোলাহলপ্রিয়  ও অন্তরালপরায়ণ’। মন চাইলে কি হবে কে যেন চালিয়ে দিয়েছে সাহানা বাজপেয়ীর রবীন্দ্রসঙ্গীত- ‘ আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, প্রাণ সখা বন্ধু হে আমার’, আকাশ কাঁদে হতাশ সম, নাই যে ঘুম নয়নে মম, দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার’।

সামিট হাউজ রেস্তোরাঁ

গতিময় গাড়ির বিপরীতে ধীরলয়ের এই গানও মনে  বিপরীতধর্মী আনন্দ জোগাচ্ছে।

রবিঠাকুরের গানের কথা ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে গাড়ির ভেতর চলছে সফলতা, ব্যর্থতাসহ জীবনের স্বপ্নজাগানিয়া সব প্রণোদনার আলোচনা। বলি, আমি সব বিষয় অনুপুঙ্খ বলতে পছন্দ করি। শ্রোতাকে প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অজানা ভেবে প্রেক্ষিতসহ সব বলতে গিয়ে কালক্ষয় হয়। ডেল কার্নেগীর একটা জনপ্রিয় জীবনভাবনা হচ্ছে বক্তার ধৈর্যশীল শ্রোতা হতে পারা সাফল্যের এক বড় উপাদান। আজকালকার মানুষ সোস্যালমিডিয়াতাড়িত। শ্রোতা হিসাবে তার সময় কম, তারা  সবকিছু নাটশেলে শুনতে চায়। অধৈর্য হয়ে বক্তব্যের মধ্যেই দুম করে উপসংহার জানতে চায়। আমি বলেই চলি, ছোট জিনিসকে কল্পনার বিস্তারে বড় করতে পারা এক আর্ট, অন্তত সাহিত্যে।  এই ডিটেইলাররা জীবনে খুব অসফল তাও বলা যাবে না। অর্থের মাপকাঠিতে সাফল্য বিচার এদের কাছে গৌণ।

স্টেয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরে পল নিবিষ্ঠ গাড়ি চালানোয়। গাড়িভর্তি সকলের নিরাপত্তা আপাত: তার নিবিষ্টতায়।  তবু ভেতরের আলোচনা সে মন দিয়ে শোনে,  অনুপুঙ্খ বলাটাকে আর্ট বলে স্বীকার করে নেয়। তবে তার বক্তব্য হচ্ছে, নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে ক্রমশ: বিষয় সংক্ষিপ্ত হতে থাকে। নিচের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বয়ান শীর্ষকর্তার কাছে এক লাইন বা নাটশেল আকারে পেশ হয়। চাকরির ক্ষেত্রে যে যতো নাটশেলে বলতে পারে, সে ততো দক্ষ ও সফল। গাড়ির ভেতরের অন্য সবাই তার কথারই সমর্থন করে। আমার অনুপুঙ্খ বলার যুক্তি খুব একটা সমর্থন পায় না। সবাই প্রায় বয়সে আমার চেয়ে বয়ো:কনিষ্ঠ। এরা  প্রযুক্তিযুগের মানুষ। জেনারেশন গ্যাপে এদের চিন্তাচেতনা স্বভাবীরকমে আলাদা। অনুপুঙ্খ কথন ভঙ্গিটি  ষাট সত্তর দশকের গল্পবাজ মানসকিতা থেকে এসে থাকতে পারে ভেবে আমি প্রসঙ্গান্তরে যাই।

রেন্টনের লিবার্টি পার্ককে ডানে রেখে আমরা ফ্রি ওয়ে থেকে নেমে যাই ১৬৯ নম্বর সড়কে। এই সড়ক ধরে শর্টকার্টে ক্রিস্টাল মাউন্টেনে যাওয়া যাবে বলে জিপিস দেখাচ্ছে। তাকোমা বন্দর থেকে আরেক সড়ক ধরে গেলে পর্বতপ্রান্তে এলবি শহর পাওয়া যায়। এখান থেকে মিনারেল শহর পর্যন্ত ভিন্টেজ রেলের চড়ে রেলগাড়ি চড়েই  মাউন্টরেইনিয়ার দূর থেকে দেখা যায়। আমাদের আগ্রহ ক্রিস্টাল মাউন্টেনের চূড়ায় কোমর সমান্তরালে বসে রেইনিয়ারসুন্দরীকে দর্শন।