খেলাপি ঋণের নীতিমালায় পরিবর্তন আসছে
দেশের ব্যাংক খাতকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে খেলাপি ঋণের নীতিমালায় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের অংশ হিসেবে ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিসহ মোট সাতটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলো খেলাপি ঋণ কমাতে ও ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যাংক কোম্পানি আইন, অর্থঋণ আদালত আইন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, নিগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট ও দেউলিয়া বিষয়ক আইন পর্যালোচনা করে আরো কঠোর করার সুপারিশ করবে। দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে মার্জার বা একীভূত করতে নীতিমাল চূড়ান্ত করবে।
আরো জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতের সার্বিক অবস্থা জানতে জনতা, এবি ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এসব ব্যাংকের শীর্ষ ৫ ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান, শীর্ষ ৫ প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফ, শীর্ষ ৫ প্রতিষ্ঠানের ঋণ অবলোপন সংক্রান্ত বিষয় পর্যালোচনা করবে কমিটি।
এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে খেলাপি ঋণের নীতিমালায় পরিবর্তন আনার বিষয়টি পর্যালোচনা করা, নিজ ব্যাংকের বাইরে অন্য ব্যাংক থেকে পরিচালকদের ঋণ নেয়ার ঘটনা খতিয়ে দেখা, ঋণ বিতরণ ও তদারকিতে পর্ষদের ভূমিকার মূল্যালয়ন করার পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে।
তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় সরকার। নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এবং নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধান করে আর্থিক খাতকে উদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন জাল জালিয়াতি, খেলাপি ঋণের লাগামহীণ ঊর্ধ্বগতি, মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট এসব কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। এতে বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। তারল্য সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক থেকে নতুন ঋণও পাচ্ছে না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ব্যাংক খাত থেকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে প্রধান করে গঠন করা কমিটি ব্যাংক কোম্পানি আইন, অর্থঋণ আদালত আইন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, নেগোসিয়েবল ইন্সুমেন্ট অ্যাক্ট, দেউলিয়া বিষয়ক আইন পর্যালোচনা করবে। পরে কমিটির সদস্যরা আইনে নতুন ধারা সংযোজন বা বিয়োজনের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রতিবেদন আকারে গভর্নরকে দেবে। গভর্নর এর আলোকে ব্যবস্থা নেবেন।
আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ড. মো. কবির আহমদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি দুর্বল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলক মার্জার ও একীভূত করার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রনয়ন করবে।
ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এ কে এম আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা এবং ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ ৬ মাসভিত্তিতে চক্রবৃদ্ধি হারে আরোপ, একক ঋণ গ্রহীতার সীমার আইনগত বাধ্যবাধকতা থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসহ সরকারের অবকাঠামোগত বৃহৎ ঋণ প্রকল্পগুলোকে অব্যাহতি দেয়া, খেলাপি ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের সংজ্ঞা পুনঃপর্যালোচনা করতে কমিটি করা হয়েছে।
ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরুপনে সুপারিশ করবে।
এছাড়া বিশেষ পরিদর্শনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ৫টি বৃহৎ খেলাপি ঋণ, ৫টি বৃহৎ পুনঃতফসিলী ঋণ, ৫টি বৃহৎ ঋণের সুদ মওকুফ সংক্রান্ত কেস এবং ৫টি বৃহৎ অবলোপনকৃত ঋণের সব তথ্য পর্যালোচনা করতে হবে।
এর মধ্যে আছে গ্রাহকদের আবেদন, শাখার মূল্যায়ন, প্রধান কার্যালয়ের মূল্যায়ন, পর্ষদ বা ব্যবস্তাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, মঞ্জুরীপত্র, প্রকল্প পরিদর্শন প্রতিবেদন, সহযোগী জামানতের মূল্যায়ন, আইনগত মতামত, ডকুমেন্টেশন, ঋণ বিতরণ ও তদারকির বিষয়াদি খতিয়ে দেখা হবে।
আর ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিট বিভাগ ও আঞ্চলিক অফিস থেকে ওইসব ঋণের বিষয়ে যতগুলো অডিট পরিচালিত হয়েছে সেসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা। বহিঃনিরীক্ষা প্রতিবেদনে কোনো নেতিবাচক মতামত রয়েছে কিনা তাও যাচাই করা।
এ বিষয়ে বাণিজ্যিক অডিটের আপত্তিগুলো পর্যালোচনা করা এবং পর্ষদকে বিভিন্ন সময়ে ওইসব ঋণের হালনাগাদ অবস্থা অবহিত করা হয়েছে কিনা, এতে পর্ষদের কোনো মতামত ছিল কিনা তা যাচাই করে দেখা হবে।
আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ওইসব ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শনে কোনো পর্যবেক্ষণ থাকলে তা পরিপালনের সর্বশেষ অবস্থা যাচাই করে দেখা হবে। ঋণের বিষয়ে ব্যাংকের সম্পদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির মতামত যাচাই করা হবে।
একই সঙ্গে বিগত দুই বছরে ব্যাংক থেকে কি পরিমাণ জনবল স্বেচ্ছায় পদত্যাগ বা অপসারণ বা ছাঁটাই করা হয়েছে এবং কী পরিমাণ জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার বিবরণী পর্যালাচনা করা হবে।
ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ অবস্থার ওপর প্রণীত কোনো প্রতিবেদন থাকলে তাও পর্যালোচনা করবে কমিটি। এছাড়াও ব্যাংক পরিচালকদের অন্য ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের বিবরণী ও ব্যাংক পরিচালনায় পর্ষদের ভূমিকা পর্যালোচনা করা হবে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা তাদের ঋণ নিয়মিত দেখানোর জন্য আদালতের মাধ্যমে সিআইবিতে যেসব স্থগিতাদেশ পেয়েছেন সেগুলোর ব্যাপারে ব্যাংকের ভূমিকা বা আইনি পদক্ষেপ পর্যাপ্ত ছিল কিনা তা যাচাই করে দেখা হবে। এই ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫টি বড় অংকের ফাইল পর্যালোচনা করতে হবে।