কেলেঙ্কারির হোতারা এমএল ডায়িং আইপিওতে
ঢাকা: শেয়ার বাজারে সিকিউরিটিজ আইন লংঘন করা কেলেঙ্কারির হোতারা এমএল ডায়িংয়ের পর্ষদে থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। এমন একটি কোম্পানি বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন পাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্য উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, ফার গ্রুপের (এফএআর) একটি প্রতিষ্ঠান এমএল ডায়িং লিমিটেড। একই গ্রুপের আরও দুটি প্রতিষ্ঠান বাজারে তালিকাভুক্ত। একটি আরএন স্পিনিং অপরটি ফার কেমিক্যাল। দুটি প্রতিষ্ঠানের এবং পর্ষদের অনিয়ম প্রমাণ পাওয়ায় কোম্পানি ও পরিচালকদের জরিমানা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এর মধ্যে আরএন স্পিনিং মিলের রাইট শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বর্তমানে পরিচালক এবং ফার গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের ফারুক কে (এমএল ডায়িংয়ের উদ্যোক্তা পরিচালক) অপসারণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ৪৬৪ তম সভায় এ সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। শুধু তাই নয় রাইট শেয়ার ইস্যু সংক্রান্ত আইন ভঙ্গের কারণে ওই কোম্পানির (আরএন স্পিনিং) সচিব কেও অপসারণ করা হয়।
একই সঙ্গে ১৯৬৯ সালের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্সের সেকশন ২২ অনুসারে কোম্পানিকে ১০ লাখ, পরিচালক শিরিন ফারুক (এমএল ডায়িং এর উদ্যোক্তা পরিচালক)কে ২৫ লাখ এবং অন্যান্য পরিচালককে ৫০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতের মাধ্যমে তা সুরাহা হয়।
অপরদিকে ফার কেমিক্যালের আইপিও অনুমোদনের পর নানা অসত্য তথ্য কমিশনে দাখিল করার প্রমাণ পায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এ কারণে ৫২৬ তম কমিশন সভায় প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করে বিএসইসি। আর এসব অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির হোতারাই এম এল ডায়িং এর সঙ্গে জড়িত। তারাই এমএল ডায়িংয়ের উদ্যোক্তা পরিচালক। আর এসব কেলেঙ্কারিরা হোতারা সদ্য অনুমোদন পাওয়া আইপিও এমএল ডায়িংয়ে জড়িত থাকার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
এ সম্পর্কে এমএল ডায়িংয়ের কোম্পানি সচিব একেএম আতিকুর রহমান বার্তা২৪.কম কে বলেন, গ্রুপের অন্য কোম্পানিতে অনিয়ম হলেও এটাতে হবে তেমনটি নয়। তাছাড়া অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তারা এমএল ডায়িংয়ের শুরু থেকে থাকলেও বর্তমানে নেই।
তবে কোম্পানির এই কর্মকর্তা উদ্যোক্তা পরিচালকরা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে নেই বললেও এমএল ডায়িং আইপিও প্রসপেক্টাসের ৪১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে, এমএল ডায়িংয়ের প্রি-আইপিওতে উদ্যোক্তা পরিচালক আব্দুল কাদের ফারুক এবং শিরিন ফারুক এর প্রত্যেকের ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ করে শেয়ার রয়েছে। তাছাড়া পোস্ট-আইপিওতে তাদের প্রত্যেকের শেয়ার ধারনের পরিমাণ দাড়াবে ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এদিকে, এমএল ডায়িংয়ের চেয়ারম্যান ফাইয়াজ কাদের। তার ব্যবসার অভিজ্ঞতা মাত্র ৩ বছর। আর তিন বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান কতটুকু ব্যবসা সফল হবেন এবং বিনিয়োগকারীরা কতটুকু লাভবান হবে তা নিয়েও শেয়ার বাজারে চলছে আলোচনা সমালোচনা। এসব বিতর্কিত কোম্পানিকে আইপিও অনুমোদন না দেয়ার দাবী জানান বিনিয়োগকারীরা।
প্রসপেক্টাসে দেয়া আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোম্পানির গত পাচ বছরের করপরবর্তী মুনাফা বেশ তারতম্য রয়েছে। তাছাড়া আলোচিত সময়ের শেয়ার প্রতি আয়ে(ইপিএস) কমে এসেছে। একই সঙ্গে কোম্পানির পণ্য বিক্রিও ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া নগদ অর্থ প্রবাহে নেতিবাচক দিক লক্ষ্য করা গেছে। কোম্পানির শুরু পর থেকে এ পর্যন্ত লভ্যাংশ দেয়ার ইতিহাসও নেই। এসব কারণে কোম্পানিটি ভবিষ্যতে ঝুঁকিপূর্ণ বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
তথ্যমতে, এমএল ডায়িং ২০১৩ সালে করপরবর্তী মুনাফা করেছে ৬৮ কোটি টাকা এবং শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল ৪ টাকা ৮৫ পয়সা। পরবর্তী সময়ে কোম্পানির মুনাফা এবং ইপিএস ধারাবাহিক ভাবে কমেছে। ২০১৬ সালে কোম্পানির করপরবর্তী মুনাফা হয়েছে ১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং ইপিএস হয়েছিল ১ টাকা ১৮ পয়সা।অর্থাৎ করপরবর্তী মুনাফা এবং ইপিএসে বড় হোচট খেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে আইপিওতে আসার আগে ২০১৭ সালের ৩০ জুন কোম্পানির করপরবর্তী মুনাফা সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং ইপিএস ১ টাকা ৫৮ পয়সা।অর্থাৎ পাচ বছরের মধ্যে চারবছরই করপরবর্তী মুনাফা এবং ইপিএস ধারাবাহিক ভাবে কমেছে। কোম্পানির পণ্য বিক্রি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হওয়ায় মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।তাছাড়া কোম্পানির নগদ অর্থের প্রবাহও (ক্যাশ ফ্লো)নেগেটিভ। এসব কারণে কোম্পানিটির ভবিষ্যত ঝুকিপূর্ণ বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, একটি কোম্পানি পাচ বছরের মধ্যে চার বছর যেখানে ধারাবাহিকভাবে মুনাফা কমেছে সেখানে কিভাবে এক বছরে ভালো কিছু করবে। তাছাড়া সামনে নির্বাচনী বছর। অতীতে জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে ব্যবসা অন্যান্য সময়ের তুলনায় মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করতে দেখা গেছে। এতে পুরো মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একই সঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠানে নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে কোম্পানিটি একটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
উল্লেখ্য, এমএল ডায়িংকে শেয়ারবাজার থেকে ২০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসইসি। সে অনুযায়ী গত ৮ জুলাই থেকে কোম্পানির অর্থ সংগ্রহ করতে আবেদন শুরু হয়েছে, যা ১৯ জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বর্তমান বাজারে যেসব আইপিও আসছে তাদের বেশির ভাগই মন্দাবস্থা।আর এসব দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ায় দিন দিন ভালো শেয়ারের অভাব বাড়ছে। এতে বাজার দীর্ঘ মেয়াদী অস্থিরতায় সহায়তা করবে। আর তাই ভালো কোম্পানির আইপিও বাজারে আসার অনুমোদন দেয়ার জন্য নিয়ন্ত্রন সংস্থা বিএসইসির নিকট দাবী জানায় তারা।