মাধ্যমিক পর্যায়ে বুলিং প্রমাণিত হলে ‘ছাড়পত্র’
মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে সহপাঠিদের দ্বারা কোনও শিক্ষার্থীকে অপমান, অশালীন আচরণ ও মানসিক আঘাতকে ‘বুলিং’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়। নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, বুলিংয়ে ফৌজদারী অপরাধ হয় না। তবে ফৌজদারী অপরাধের মতো কিছু ঘটার আগাম তথ্য পেলে পুলিশের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। আর তা প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ছাড়পত্র (টিসি) দেয়া যেতে পারে।
তবে খসড়া নীতিমালায়, স্কুলে বুলিং প্রতিকারের চেয়ে স্কুলের পরিবেশ ভীতিমুক্ত ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে শিক্ষার্থী বন্ধব করা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনতা তৈরির ওপর বেশী গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি এ খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করেছে। গত ১০ জুলাই খসড়া নীতিমালাটি হাইকোর্টে জমা দেয়া হয়েছে। আর আগামী ২২ অক্টোবরের মধ্যে এই নীতিমালা চূড়ান্তের অগ্রগতি জানাতে হবে।
বুলিংয়ের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায়ই স্কুল বুলিংয়ের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বুলিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে চায় না। এতে শিক্ষণ ও শিখন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। স্কুলের পরিবেশও নষ্ট হয়।
খসড়া নীতিমালায় বুলিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বিদ্যালয় চলাকালীন সময় বা বিদ্যালয় শুরু হওয়ার আগে বা পরে, শ্রেণিকক্ষে বা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বা বাইরে কোনও শিক্ষার্থী কর্তৃক (এককভাবে বা দলগতভাবে) অন্য কোনও শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে আঘাত করা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা, অশালীন বা অপমানজনক নামে ডাকা, অসৌজন্যমূলক আচরণ করা, কোনও বিশেষ শব্দ বারবার ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত বা বিরক্ত করাকে স্কুল বুলিং হিসেবে গণ্য করা হবে।
নীতিমালায় মৌখিক, শারীরিক ও সামাজিক- এই তিন ধরনের বুলিং চিহ্নিত করা হয়েছে। যদি কাউকে উদ্দেশ্য করে এমন কিছু বলা বা লেখা বা খারাপ কিছুর প্রতি ইঙ্গিত করা, উপহাস করা, খারাপ নামে সম্বোধন ও অশালীন শব্দ ব্যবহার ও হুমকি দেয়া হয় তাহলে সেটা মৌখিক বুলিং হবে।
যদি কাউকে কোনও কিছু দিয়ে আঘাত, চড়-থাপ্পড় দেয়া, লাথি ও ধাক্কা মারা, থুথু নিক্ষেপ, জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা ও মুখ বা হাত দিয়ে অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি করা হয় তাহলে শারীরিক বুলিং হবে।
যদি সামাজিক স্ট্যাটাস, একক বা দলগত বন্ধুত্ব বা পারস্পরিক সম্পর্ক, ধর্মীয় পরিচিতি বা বংশগত অহংবোধ থেকে কোনও শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা, কারও সম্পর্কে গুজব ছড়ানো এবং প্রকাশ্যে কাউকে অপমান করা, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বা জাত নিয়ে কোনও কথা বলা হয় তাহলে সামাজিক বুলিং হবে।
বুলিং প্রতিরোধে অভিভাবকদের করণীয় সম্পর্কে নীতিমালায় বলা হয়েছে, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীকে স্কুলের নিয়মকানুন মেনে চলা ও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে হবে। পিতামাতা তাদের সন্তানদের ভালবাসার মাধ্যমে মূল্যবোধ শিক্ষা দিবেন। সন্তান বুলিংকারী বা বুলিংয়ের শিকার যাই হোক না কেন, পূর্বাপর না জেনে ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকবেন। কারো সামনে পিতা-মাতা ঝগড়া বিবাদে জড়িত হবেন না। বুলিংকারীর বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনও সিদ্ধান্ত নিলে বিরোধিতা না করে সহযোগিতা করা।
আর স্কুলের ক্ষেত্রে যে কোনও ধরণের বুলিংয়ের ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা (জিরো টলারেন্স) গ্রহণ করা। স্কুল বুলিংয়ের সর্বোচ্চ শান্তি হিসেবে টিসি প্রদানের পূর্ব ঘোষণা দেওয়া, বুলিংয়ের ঘটনায় অভিযোগ শোনা ও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া, যেকোনও ব্যবস্থা নিরপেক্ষভাবে গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক উচুনিচু ভেদাভেদ করা যাবে না। স্কুলের বিরতির সময় তদারকি জোরদার, স্কুল প্রাঙ্গণ, করিডোর ও শ্রেণিকক্ষ সিসিটিভির নজরদারিতে রাখা, বুলিংয়ের খারাপ দিক তুলে ধরে স্কুলে নাটক বা অভিনয় মঞ্চস্থ করা, বুলিংয়ের ভুক্তভোগীকে শিক্ষক ও স্কুলের কর্মীদের মানসিক সমর্থন দেয়া ও স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখতে শিক্ষকদের চাপমুক্তভাবে দায়িত্ব পালনের পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, বুলিংকারী এবং বুলিংয়ের ভুক্তভোগীর কাছ থেকে লিখিত বিবরণ নেওয়া উত্তম। যদি সাক্ষী থাকে তাহলে লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করা। তাদের আলাদা আলাদা বক্তব্য শুনবে প্রতিরোধ কমিটি। উভয়কে যত্নসহকারে কাউন্সেলিং করা উচিত, যাতে তাদের আচরণে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, সাইবার বুলিং যেমন- বাজে ক্ষুদেবার্তা বা গোপন কিছু অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি একটি নতুন সমস্যা। এ ধরণের অভিযোগ পেলে তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ শিক্ষক বা স্কুলের কর্মী দ্বারা ঘটনা তদন্ত করতে হবে। স্কুলে ইলেকট্রনিক ডিভাইস আনা, ছবি তোলা ও ভিডিও নিষিদ্ধ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা, যেকোনও পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের পরামর্শ নিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া, স্কুলে কোনও প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দল বা উপদলের সৃষ্টি হয় তা লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রসঙ্গত, ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রি অধিকারী আত্মহত্যা করলে সুপ্রিম কোর্টের চারজন আইনজীবী ঘটনাটি নজরে আনলে ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দেন হাইকোর্ট। তখন ‘বুলিং’ প্রতিরোধ করতে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেন আদালত। আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে। যা গত ১০ জুলাই বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গাঠিত হাইকোর্টেও দ্বৈত বেঞ্চে দাখিল করা হয়। ওইদিন আদালত বুলিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা যাতে অভিযোগ জানাতে পারে সেজন্য স্কুলে অভিযোগ বাক্স খোলার বিষয়টি নীতমালায় অন্তর্ভূক্ত করার নির্দেশ দেন।