আবুল খায়ের গ্রুপের ২০০ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি, ৫৪ আপিল উচ্চ আদালতে
দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপ আবুল খায়ের কোম্পানির ২০০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কমিশনার অব কাস্টমসের করা আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে উচ্চ আদালতে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৫৪ টি আপিলের বিপরীতে বিপুল পরিমাণের এ অর্থ আটকে আছে। চলতি বছরের আগের আপিল মিলিয়ে শুল্ক ফাঁকির মামলা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আপিলগুলো নিষ্পত্তি হলে রাষ্ট্রের কোষাগারে এ টাকা জমা পড়ত। বিদেশ থেকে পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে আমদানি করা গুঁড়া দুধ, ভোগ্যপণ্য ও স্টিলের কাঁচামালে শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে কোম্পানিটি।
উচ্চ আদালতের সূত্র জানিয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত আবুল খায়ের মিল্ক প্রোডাক্টস লিমিটেডের শুল্ক ফাঁকির বিরুদ্ধে ২৯টি আপিল দায়ের করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এসব আপিলের বিপরীতে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৮৪ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ৭৬৯ টাকা। অন্যদিকে কোম্পানিটির কনজ্যুমার ও স্টিল শাখার শুল্ক ফাঁকির বিরুদ্ধে ২৫টি আপিল দায়ের করেছে কমিশনার অব কাস্টমস। এসব আপিলে শুল্ক ফাঁকির অর্থের পরিমাণ ১১৬ কোটি ৫৫ হাজার ১০৬ টাকা। সবমিলিয়ে শুল্ক ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি ৪০ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮২ টাকা।
উচ্চ আদালতে শুল্ক ফাঁকি (কাস্টমস), ভ্যাট ও আয়কর মামলার আপিল নিষ্পত্তির জন্য মাত্র দুটি বেঞ্চ রয়েছে। দুটি বেঞ্চ থাকায় মামলার শুনানি এবং নিষ্পত্তি হচ্ছে ধীরগতিতে। ফলে আবুল খায়ের গ্রুপের শুল্ক ফাঁকির আপিল এ বছরও নিষ্পত্তি হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছে, শিগগির পর্যায়ক্রমে ৫৪টি আপিল শুনানির জন্য কার্যতালিকায় (কজ লিস্ট) আসবে। কার্যতালিকায় আসার পর শুনানি শুরু হবে এসব আপিলের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল জানিয়েছেন, অনেকগুলো আপিল দায়ের করেছে চট্টগ্রামের কমিশনার অব কাস্টমস। আপিলগুলো সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রস্তুত হয়ে এখন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
কাস্টমস আপিল নম্বর ৫৫ দায়ের করা হয় গত ৭ ফেব্রুয়ারি। কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯ এর ১৯৬ অনযায়ী কমিশনার অব কাস্টমস আপিলটি হাইকোর্টে দায়ের করেন। আপিলে বিবাদী হলেন-কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল, কমিশনার অব কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট (আপিল) এবং আবুল খায়ের মিল্ক প্রোডাক্টস লিমিটেড।
আপিলের নথি থেকে দেখা যায়, আবুল খায়ের মিল্ক প্রোডাক্টস অস্ট্রেলিয়া থেকে স্কিমড গুঁড়া দুধ আমদানি করে প্রতি টন ২ হাজার ৬২৪ ডলারে।
২০১৫ সালের ৪ মে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের দাখিল করা বিল পরীক্ষা করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্য প্রতি টন ২ হাজার ৭০০ ডলার নির্ধারণ করে খালাসের আদেশ দেয়। আদেশ অনুযায়ী আবুল খায়ের মিল্ক কোম্পানি পণ্য খালাসও করে নেয়। পণ্য খালাস করে কাস্টমসের মূল্য নির্ধারণের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে তারা। ওই বছরের ২৯ জুন কমিশনার (আপিল) আবুল খায়েরর আপিল মঞ্জুর করে চালান অনুযায়ী খালাসের আদেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আপিল করলে কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল গত বছর ২৯ অক্টোবর কাস্টমসের আপিল নামঞ্জুর করে।
কাস্টমসের দাবি অ্যাপিলেট ট্রাইবুনালের পণ্যের মূল্য চালানের ভিত্তি নির্ধারণের আদেশ বহাল রেখে ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তথ্য ও প্রমাণ বিবেচনায় না নিয়ে আইনগত ভুল করেছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সকল নথিপত্র যাচাই করে দেখেছে কোম্পানিটি চালনে ঘোষিত মূল্য বিদ্যমান মূল্যের চেয়ে অনেক কম।
গত ১০ জানুয়ারি দায়ের করা ১১ নম্বর আপিলে দেখা যায় আবুল খায়ের মিল্ক প্রোডাক্টস লিমিটেড নিউজিল্যান্ড থেকে গুঁড়া দুধ আমদানি করে। ওই বছরের ২১ মার্চের চালানে প্রতি টন গুঁড়া দুধের মূল্য দেখানো হয় ২ হাজার ৩৯৯ ডলার। পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের সকল নথিপত্র যাচাই করে বিশ্ববাজারের বিদ্যমান মূল্য নির্ধারণ করেছে। কমিশনার অব কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট (আপিল) বরাবরে কোম্পানিটি আপিল করলে চালান অনুযায়ী মূল্য বহাল রাখা হয়। একইসঙ্গে অতিরিক্ত দেওয়া অর্থ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। গত বছর ১৫ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল কাস্টমসের আপিল খারিজ করে দেয়। ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে সংক্ষুব্ধ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
কাস্টমস আপিল নম্বর ৪৩ দায়ের করা হয় গত ৩১ জানুয়ারি। চট্টগ্রামের কমিশনার অব কাস্টমস (আমদানি) আপিলটি দায়ের করে। এ আপিলের বিবাদী কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল, কমিশনার অব কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট (আপিল) এবং আবুল খায়ের মিল্ক প্রোডাক্টস লিমিটেড।
আবুল খায়ের মিল্ক প্রোডাক্টস লিমিটেড গুঁড়া দুধের জন্য ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল এক চালানে জাপান থেকে প্রাথমিক গুণগতমানের ৩ টন ইলেকট্রোলাইটিক টিন প্লেট আমদানি করে। চালানে প্রতি টন টিন প্লেটের মূল্য ৭৯০ ডলার দেখিয়ে পণ্য খালাস করে আমদানিকারক আবুল খায়ের মিল্ক প্রোডাক্টস। কিন্তু কাস্টমস ভেলুয়েশন বিধিমালা ২০০০ এর ৫ ধারা অনুযায়ী প্রতি টন টিন প্লেটের মূল্য ছিল ৯০০ ডলার। কাস্টমসের দাবি একই পণ্য অন্যান্য দেশে প্রতি টন ৯০০ ডলার। এর বিরুদ্ধে রিভিউ (পুর্নবিবেচনার) আবেদন করে আবুল খায়ের মিল্ক। রিভিউ কমিটি কাস্টমসের মূল্য নির্ধারণ খারিজ করে দেয়। এর বিরুদ্ধে অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আপিল করে কাস্টমস। ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল রিভিউ কমিটির কিছুটা সংশোধন করে মূল্য নির্ধারণ করে প্রতি টন ৮৫০ ডলার। এ রায়ের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেছে।
একই ধরণে আরো অর্ধশতাধিক আপিল করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এসব আাপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে উচ্চ আদালতে।