গ্রেনেড হামলা মামলা: পেপারবুক তৈরি হলে শুনানি হবে হাইকোর্টে
২১ আগস্টের নৃশংস ও ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলায় ১০ মাস আগে বিচারিক আদালতে রায় ঘোষণা করা হয়। তবে উচ্চ আদালতে এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু হয়নি। মূলত পেপারবুক প্রস্তুত না হওয়ায় শুনানি শুরু হচ্ছে না।
উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য পেপারবুক তৈরি করতে হয়। পেপারবুকের এক মলাটে মামলার এজাহার, তদন্ত প্রতিবেদন, অভিযোগ পত্র, অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য, রায় ও যাবতীয় দলিল থাকে।
সুপ্রিম কোর্ট ও অ্যাটর্নি জেনারেল সূত্রে জানা গেছে, পেপারবুক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এটি তৈরি হলে দ্রুত শুনানির জন্য পদক্ষেপ নেবে রাষ্ট্রপক্ষ। তখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হতে পারে দেশব্যাপী আলোচিত এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী বিচারিক আদালত আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলে তা কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন নিতে হয়। মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা মোতাবেক মামলার সকল নথি হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত। যা ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত। এর মধ্যে দণ্ডিত আসামি কারাগারে থাকলে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রায়ের বিরুদ্ধে তাকে আপিল করতে হয়। বিচারিক আদালতের নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক তৈরি করে। পরে মামলার ক্রম অনুসারে শুনানির জন্য আসে কার্যতালিকায়। তবে গুরুত্বপূর্ণ বা চাঞ্চল্যকর মামলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির পদক্ষেপ নিতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন হয় প্রধান বিচারপতির সম্মতির।
মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন, পেপারবুক তৈরি হলে ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের দ্রুত শুনানির পদক্ষেপ নেবেন। বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল যেমন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হয়েছিল, ২১ আগস্ট মামলায়ও সেরকম হতে পারে। তবে কখন শুনানি হতে পারে এই মুহূর্তে নির্দিষ্ট করে সময় বলে দেয়া সম্ভব নয়। পেপারবুক তৈরি হলে দ্রুত শুনানির পদক্ষেপ নেবেন।
অন্যদিকে পেপারবুক তৈরির অগ্রগতি জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, দুইজন মুদ্রাক্ষরিক পেপারবুক টাইপ করার কাজ শুরু করেছেন। একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রার এটি তদারকি করছেন। টাইপ শেষ হলে বিজি প্রেসে পেপারবুক ছাপানোর জন্য পাঠানো হবে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গত বছরের ১০ অক্টোবর পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। যাবজ্জীবন দণ্ড দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় ১১ জনকে।
এক মাস পর মামলার রায় ও ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার নথি পৌঁছে হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায়।
রায়ে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। তারা হলেন- ১. লুৎফুজ্জামান বাবর, ২. মো. আব্দুস সালাম পিন্টু, ৩. মাওলানা মোহাম্মদ তাজউদ্দিন, ৪. মাওলানা শেখ আব্দুস সালাম, ৫. মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, ৬. মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার জাফর, ৭. মো. আব্দুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, ৮. আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মাদ ওরফে জিএম, ৯. মহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি, ১০. আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, ১১. মো. জাহাঙ্গীর আলম, ১২. হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, ১৩. হোসাইন আহম্মেদ তামিম, ১৪. মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে খাজা ওরফে আবু জানদাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, ১৫. মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাউফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ, ১৬. মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন, ১৭. মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ১৮. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম এবং ১৯. মো. হানিফ।
১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। তারা হলেন- ১. তারেক রহমান, ২. হারিছ চৌধুরী, ৩. মাওলানা আব্দুর রউফ ওরফে পীর সাহেব, ৪. মাওলানা সাব্বির আহমদ, ৫. হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, ৬. আরিফ হাসান ওরফে সুমন, ৭. শাহাদত উল্যাহ ওরফে জুয়েল, ৮. আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, ৯. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, ১০. মহিবুল মুত্তাকিন, ১১. আনিসুল মুরছালিন, ১২. মোহাম্মদ খলিল, ১৩. জাহাঙ্গীর আলম বদর, ১৪. মো. ইকবাল, ১৫. লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, ১৬. কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, ১৭. মুফতি শফিকুর রহমান, ১৮. মুফতি আবদুল হাই এবং ১৯. রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে রাতুল বাবু।
১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড হয়েছে। তারা হলেন- ১. পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও ২. শহিদুল হক, ৩. খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, ৪. লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ৫. ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ৬. ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, ৭. সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, ৮. সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, ৯. সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, ১০. সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, ১১. সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নৃশংস ও ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।
ওই ঘটনায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। হামলায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতা-কর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন।