নাদিয়া মুরাদ, আইনাল কুর্দি ও অনামা রোহিঙ্গা শিশু
২০১৮ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারত আইনাল কুর্দি। নোবেল কমিটি মরনোত্তর পুরস্কার না দেওয়ায় সে সুযোগ পায় নি মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের দগদগে প্রতীক আইনাল। মারা যাওয়ায় মহাত্মা গান্ধীও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান নি। বেঁচে থাকলে পুরস্কারটি তিনি নির্ঘাত পেতেন। নোবেল কমিটি পুরস্কার দিয়ে যত না আনন্দ প্রকাশ করেছে, গুরুত্বপূর্ণ ও যোগ্য অনেককে পুরস্কার দিতে না পারার জন্য ব্যথিত হয়েছে তারচেয়ে ঢের বেশি।
আইনাল কুর্দি ও এবারের নোবেল শান্তি পদক প্রাপ্ত নাদিয়ার প্রসঙ্গ ধরে বলা যায়, আরাকানের অনামা সেই শিশুটির কথাও, বার্মিজ নির্যাতন থেকে পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে যে নাফ নদীতে মরে-পচে-ফুঁলে ভেসে ছিল। শান্তির সন্ধানে জীবন ও স্বদেশ হারানো এইসব মৃতমুখের পাশে বেঁচে থাকা নাদিয়া যেন সকলেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন।
অনামা রোহিঙ্গা শিশু বা আইনাল কুর্দি পুরস্কার ও স্বীকৃতি না পেলেও পেয়েছেন আইনালেরই স্বদেশী (স্বজাতির নয়) নাদিয়া মুরাদ। আপাত দৃষ্টিতে নাদিয়া মুরাদ বাসিই তাহা নামের ২৫/২৬ বছরের তরুণীকে বৃহত্তর কুর্দি জাতির সদস্য ধরা হলেও তিনি তা নন। নিজেদেরকে তারা বলেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়, যারা মধ্যপ্রাচ্যে কুর্দি অধ্যুষিত ইরাক ও সিরিয়ার অঞ্চলগুলোর একটি অতি ক্ষুদ্র ধর্ম ও জাতি গোষ্ঠী। জাতিতে যেমন তারা কুর্দি পরিচয়কে অস্বীকার করেন, ধর্ম মতেও তারা মুসলিম নন। বরং একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো, যেমন ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলামের শংকর বলা হয় এ জনগোষ্ঠীকে। অনেকেই এদেরকে সুফিবাদি ও কাল্ট-ভিত্তিক রহস্যময় ধর্ম সম্প্রদায় হিসাবেও বিবেচনা করেন।
মনে রাখা ভালো, বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে একক ও প্রধান ধর্ম ইসলামের অধীনেই আছে চারটি প্রধান জাতিসত্ত্বা, যারা পরস্পরের প্রতি মৈত্রীর চেয়ে বিভেদ ও সংঘাতের ঐতিহ্য বহন করছে ঐতিহাসিক দিন থেকেই। আরব, পারসিক, তুর্কি, কুর্দি-এই প্রধান চার জাতিগুলোর বাইরে সেখানে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্ম, ভাষা ও জাতিসত্ত্বাভিত্তিক জনগোষ্ঠী রয়েছে, ইয়াজিদিরা তেমনই একটি।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চলমান নারকীয় সংঘাতের অন্তর্মূলে শিয়া-সুন্নি ধর্মীয় মতাদর্শ ও ইরান-সৌদি-সিরিয়া-তুরস্কের ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে প্রধান জাতিগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিকগুলো এখন আর অজানা থাকছে না। নানামুখী সংঘাত ও সংঘর্ষের ধারাবাহিকতায় আইএসআইএল-এর সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী ভিন্নমতের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোতে হামলা চালাতে থাকে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা ও শত শত নারীকে দাস বানিয়ে নিয়ে যায় উগ্রবাদীরা। নাদিয়া মাত্র ১৯ বছর বয়সে এই আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি বর্বর মধ্যযুগীয় বন্দি শিবিরে আটক হন। নানা রকমের নিপীড়ন-নিযাতনের পাশাপাশি তিনি যৌন লাঞ্ছনা ও মানব পাচারের মতো বীভৎস অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন আরও হাজার হাজার নারীর মতোই।
নাদিয়ার সৌভাগ্য যে তিনি সন্ত্রাসী-জঙ্গিদের মৃত্যুকূপ থেকে পালিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলেন মুক্ত পৃথিবীতে। বিশ্ববিবেককে জানাতে পেরেছিলেন যুদ্ধ ও সংঘাতের বাতাবরণে চলতে থাকা নারী ও শিশুদের প্রতি অমানবিক আচরণ, যৌন অত্যাচার, দাসবৃত্তি ও মানব পাচারের বিষয়গুলো। মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন লড়াইরত গ্রুপগুলোর কাছে আদর্শের চেয়ে মূল্যবান, তেমনি ধৃত নারী-শিশুদের সম্ভোগ ও বিক্রি করাটাও আরেকটি লাভজনক অপকর্ম। নাদিয়া তার অভিজ্ঞতার কথা জাতিসংঘ, পোপ এবং বিশ্বের নানা স্থানে বর্ণনা করেছেন এবং নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন ‘দ্য লাস্ট গার্ল: মাই স্টোরি অব ক্যাপ্টিভিটি’ এবং ‘মাই ফাইট এগেইস্টে ইসলামিক স্টেট’ নামক গ্রন্থে। ‘অন হার সোল্ডার’ নামের একটি ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রেও তিনি বিবৃত করেছেন যুদ্ধের অন্ধকার ও ভয়াবহতার অমানবিক দিকগুলোকে।
সংঘাত ও যুদ্ধের বিভীষিকার একই দুর্ভাগ্য ডেকে আনে মধ্যপ্রাচ্যের এবং পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ নারী, শিশু ও মানুষের। আইনাল কুর্দি তেমনই একজন, যে ছোট্ট শরীরটি নিয়ে মরে পড়েছিল সমুদ্র উপকূলে। সংঘাতের কবল থেকে বাঁচতে গিয়ে মানব পাচারকারীদের সবকিছু দিয়ে পালাতে চেয়েছিল আইনালের পরিবার। ভুল পথে তারা চলে যায় মৃত্যুর ঠিকানায়। আইনাল তার কাহিনী নাদিয়ার মতো লিখে যেতে পারে নি। আইনালের কথা লিখেছে বিশ্ব মিডিয়া এবং কানাডায় অপেক্ষারত তার বোন তিমা আবদুল্লাহ। যেমনভাবে নাফ নদী তীরের অনামা রোহিঙ্গা মৃতশিশুটির না-বলা কথা বলেছে বিশ্বের মানবিক কণ্ঠস্বর।
নাদিয়ার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির সময় অবশ্যই মনে পড়বে যুদ্ধ ও সংঘাতে মৃত, আহত, যৌন অত্যাচিত, দাসরূপে বিক্রি হয়ে যাওয়া কিংবা মানব পাচারের পথ ধরে মুক্তির সন্ধানে গিয়ে জীবন হারানো লক্ষ লক্ষ মানুষের কথা। নাদিয়ার যে ক্ষুদ্র জাতিটি হাজারা বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের নিজের ভূমিতে বসবাস করছিল, তারাও আর সেখানে থাকতে পারে নি। ইয়াজিদি সম্প্রদায় এখন জার্মানি, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে বেঁচেছে। অনেকেই ধুকছে উদ্বাস্তু শিবিরে। বলা হয়, অতি ক্ষুদ্র এই সম্প্রদায়ের ৮০% মানুষই হয় মরেছে, নয় পালিয়ে গেছে!
ইয়াজিদি নাদিয়ার সহনাগরিক মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দিরাও একই পরিস্থিতির শিকার। আইনালের ভেসে আসা লাশের মতো এই জাতিটিও উদ্বাস্তু হয়ে ভাসছে বিশ্বের পথে-প্রান্তরে। একদা মুসলিম গৌরবের প্রতীক ক্রুসেড-বিজয়ী গাজি সালাহউদ্দিন আইয়ুবির বংশধর কুর্দি জাতি সংখ্যায় বড় হলেও দেশহারা। তাদের জন্মভূমি ভাগ হয়ে গেছে ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, আর্মেনিয়ায়। স্বাধীনতা ও স্বদেশ পাওয়ার বদলে বেঁচে থাকার অধিকারও হারিয়েছে কুর্দি জনগোষ্ঠী। সংঘাত ও যুদ্ধের আঘাতে দিকভ্রান্ত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের আরেক প্রান্তে। খুব সামান্য বাঁচতে পারছে। অধিকাংশই মানব পাচারের শিকার হয়ে মরেছে দুর্ভাগা আইনাল কুর্দির মতো। কিংবা নাম ও ধর্ম হারিয়ে বিক্রি হয়ে গেছে অড্রেয়াটিক সাগরের অপর প্রান্তীয় শহর ট্রিয়েস্ট, ভিয়েনা, নিকোশিয়ার ব্রোথেল ও নাইট ক্লাবে। ইউরোপের দরজায় কুর্দিদের কান্না ও আর্তনাদ ভারী করেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকে।
ভূগোলের আরেক সীমানায় দক্ষিণ এশিয়ার মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ভোগ করছে অনুরূপ নির্মমতম জাতিগত আক্রমণ। মানবাধিকারের নূন্যতম সুযোগও বঞ্চিত হয়েছে তারা। জন্ম অধিকার ও হাজার বছরের বসবাসের স্বীকৃতি ও নাগরিকত্ব হারিয়ে রোহিঙ্গারা পাখির মতো মারা যাচ্ছে বার্মিজদের হাতে। যত ধরনের শারীরিক, মানসিক, যৌন নিপীড়ন আছে, সবই প্রয়োগ করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে। প্রাণ বাঁচাতে মরণ সাগর পেরিয়ে রোহিঙ্গারা স্বদেশ ছাড়ছে। আসার সময় পথে পথে মরেছে তারা। মৃত বাপ, মা, ভাই, বোন, স্বজনকে ফেলেই সর্বশ্রান্ত হয়ে ঠাঁয় নিয়েছে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে। সেখান থেকে সুযোগ পেলেই মানব পাচারকারীদের হাত ধরে নানা বৈধ-অবৈধ পথে পালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের নানা দেশে। কখনো পালিয়ে বাঁচতে পারছে, অধিকাংশ সময়ই আইনাল কুর্দি বা অনামা রোহিঙ্গা শিশুর মতো মারা পড়ছে। ইয়াজিদি সম্প্রদায়, কুর্দি এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর মতোই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ এখন দেশছাড়া উদ্বাস্তু।
মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন নেত্রী অং সাং সুচিকে সেদেশের সামরিক বাহিনী অবরুদ্ধ ও দেশছাড়া করলে তিনি পেয়েছিলেন শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার। আর এখন যখন সুচি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিশে আস্ত রোহিঙ্গা জাতিকেই দেশছাড়া করছেন, তখন রোহিঙ্গারা পাচ্ছে মৃত্যুর যন্ত্রণা ও স্বদেশ হারানোর বেদনা। সুচির মতো যেসব অপশক্তি মধ্যপ্রাচ্যে কুর্দি বা ইয়াজিদিদের জীবন বিষিয়ে দিচ্ছে এবং প্রাণ হরণ করছে, একদিন হয়ত তারাও সুচির মতো নোবেল শান্তির দাবিদার হয়ে দাঁড়াতো, যদি না ভাগ্যক্রমে নাদিয়া মুরাদ বেঁচে ফিরে আসতেন। তিনি নিজের এবং আইনাল কিংবা রোহিঙ্গা শিশুটির হয়ে বিশ্বের সামনে কথা বলেছেন যুদ্ধবাজ, জঙ্গি, জাতিগত নিধনকারী, যৌণ নিপীড়িকদের বিরুদ্ধে। জানিয়েছেন যুদ্ধের ছদ্মবেশে নারীকে খুবলে ফেলার ও মানব পাচারের মর্মান্তিক বিবরণ। তিনি প্রকাশ করেছেন যুদ্ধের ভেতরে চলমান আধুনিক দাসবৃত্তির কথাও।
যুদ্ধ ও সংঘাতের কবল থেকে বাঁচার জন্য মানুষের চিরায়ত আকুতির যে প্রকাশ নাদিয়া মুরাদ করেছেন, তা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। ইয়াজিদি, কুর্দি, রোহিঙ্গা এবং বিশ্বের সকল যুদ্ধাক্রান্ত বিপণ্ন মানুষের একীভূত আর্তি ধারণ করেছে নাদিয়ার ব্যক্তিগত উচ্চারণ। আইনাল কুর্দি, অনামা রোহিঙ্গা শিশু এবং যুদ্ধ প্রান্তরে নিহত শত-সহস্র নারী, শিশু, মানুষের হিস্যা হয়ে নাদিয়ার গলায় যে নোবেল শান্তি পুরস্কার উঠেছে, তা আসলে নিছক কোনও পুরস্কার মাত্র নয়; তা হলো যুদ্ধবাজ, জঙ্গি ও নিপীড়িকদের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক ভৎসনা; আইনাল ও রোহিঙ্গা শিশুর পক্ষ হয়ে আইএসআইএল বা সুচির গালে প্রচণ্ড চপোটাঘাত; মানবতার বিরুদ্ধে আক্রমণকারীদের মুখে ছিটিয়ে দেওয়া একদলা ঘৃণার থু থু।