জীবনে রাসূলের সুন্নত অনুসরণের গুরুত্ব

  • মোমতাহানা সুরভি, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জীবনে রাসূলের সুন্নত অনুসরণের গুরুত্ব, ছবি: সংগৃহীত

জীবনে রাসূলের সুন্নত অনুসরণের গুরুত্ব, ছবি: সংগৃহীত

বাসার নিচ তলায় ছোট একটা মেয়ে থাকে। বয়স ৬-৭। যখনই নিচে নামি মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়। আমার দশ মাস বয়সী মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদর করার খুব শখ ওর। যেদিন নিচে নামা হয় না, সেদিন নিজেই বাসায় আসে মেয়েকে দেখতে। একদিন আসলো ভরদুপুরে। দুপুরের খাবারের জন্য টেবিল গুছাচ্ছিলাম। মেয়েটাকে দুপুরে খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে মাথা নাড়িয়ে নাসূচক উত্তর দিলো। খেতে দিতে চাইলা, দুই-তিনবার অসম্মতি জানালো। পরে জোর করে প্লেটে ভাত দিতেই বসে গেলো। ওর খাওয়া দেখে বুঝলাম, সকাল থেকে তেমন কিছু খায়নি। আলাপে আলাপে জানলাম- দুপুরেও ওদের রান্না শেষ হয়নি। কারণ ওর মা অন্যের বাসায় কাজ করে, তাই বাসায় এসে নিজের রান্না শেষ করতে বেশ দেরী হয়। মেয়েটা চুপচাপ খেয়ে চলে গেলো।

ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমার মনে পড়লো হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি হাদিসের কথা। যেখানে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ক্ষুধার্ত প্রতিবেশী রেখে নিজেরা ভালো কিছু খেতে নিষেধ করেছেন। এমনকি তরকারির ঝোল বাড়িয়ে দিতে বলেছেন, যাতে প্রতিবেশীকে দেওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

হাদিসে প্রতিবেশীর অধিকারের কথা নবী করিম রাসূল (সা.) এতবার বলেছেন যে, সাহাবারা ভয় পেতেন প্রতিবেশীদের না আবার সম্পত্তির উত্তরাধিকার ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়।

বর্তমানের যান্ত্রিক এই যুগে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আমরা প্রতিবেশীদের থেকেও পরিচিত হওয়ার চেষ্টা পর্যন্ত করি না। ভাবতে খুব ভয় লাগছিলো- প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ভিতটা কতটা মজবুত হলে জানা যায় তার সুখ-দুঃখের কথা, জানা যায় তার অভাবের কথা। আমরা সেই সম্পর্কের দাবী কতটা রক্ষা করতে সক্ষম?

বিজ্ঞাপন

ঘটনা-২: মেয়েটাকে টীকা দিতে গেলাম। টীকাদান কেন্দ্রে খুব ভিড়, লম্বা লাইন। আমার সামনে আরও দশজনের সিরিয়াল। সময় লাগবে, কিছু করার নেই। আমার সামনে লাইনে দাঁড়ানো মহিলার কোলে একটা বাচ্চা, পাশে বোরকা ধরে টানাটানি করছে বড় বাচ্চাটি। দুই বাচ্চাকে নিয়ে মহিলা বেশ বিপদে আছেন- বুঝাই যাচ্ছে। বড়জন কিছুতেই দাঁড়াতে দিচ্ছে না- মাকে। সে এখনই এখান থেকে বের হয়ে যাবে, শুধু কান্না করছে। তার চিৎকারে আশপাশের সবাই বিরক্ত। মহিলার সঙ্গেও কেউ নেই, যে বড়জনকে একটু শান্ত করবে, কোলের বাচ্চাকে নিয়ে বড় বাচ্চাকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। দেখে খারাপ লাগছিল। কিন্তু কিছু করার নেই।

হঠাৎ লাইনে দাঁড়ানো একদম সামনের মহিলা এগিয়ে এলেন তার কাছে। এসে বললেন, আপা! আপনি আমার সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আগে টীকা দিয়ে চলে যান। আমি আপনার সিরিয়ালে দাঁড়াই, আমার দেরি হলেও সমস্যা নেই। এই ব্যস্ততার সময়ে কেউ যেখানে কাউকে ছাড় দিতে চায় না, সেখানে এমন সাহায্য পেয়ে দুই বাচ্চার মা খুশিতে অভিভূত। প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালো আশেপাশের সবাই। নিজের অধিকার ছেড়ে দিয়ে অন্যকে সাহায্য করার এমন মানসিকতা সত্যিই বিরল।

মনে পড়লো হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করলেন। মক্কার মুহাজির ভাইদের জন্য মদিনার আনসার সাহাবারা নিজের একজন স্ত্রী রেখে আরেকজন স্ত্রী ছেড়ে দিয়েছিলেন। আরও মনে পড়লো যুদ্ধের ময়দানে মুমূর্ষ আহত সাহাবারা যখন নিজের শেষ মুহূর্তের মুখের পানি পাশের মুমূর্ষ ভাইয়ের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছিল।

সাহাবাদের চূড়ান্ত আত্মত্যাগ, নিজের ওপর অপরের অধিকারকে প্রাধান্য দেওয়ার সেই স্বর্ণালী ইতিহাসের কথা। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই বলেছেন, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ করো; অথচ একে অপরকে ভালোবাসা, বিপদে সাহায্য করা, পাশে দাঁড়ানোর এই সুন্নত অনুসরণের মানসিকতা আমাদের দিন দিন কমে যাচ্ছে।

ঘটনা-৩: সেদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটা রিকশার সামনে ছোট একটা জটলা দেখে দাঁড়ালাম। দেখি এক ভদ্রলোক রিকশাওয়ালাকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে রাস্তায় প্রায় শুইয়ে ফেলেছেন। রিকশাওয়ালার অপরাধ, তিনি নাকি যা ভাড়া তার চেয়ে পাঁচ টাকা বেশি চেয়েছেন। ভাড়া বেশি চাওয়ার অপরাধে ওই যাত্রী ভদ্রলোক তাকে এভাবে মারছে। রাস্তায় সবাই জড়ো হয়ে রিকশাওয়ালার দুর্দশা দেখছে, কেউ আরও উৎসাহী হয়ে নিজেও দুই-চারটা চড় লাগিয়ে দিচ্ছে। দেখে মনে হলো- চোর ধরার পর গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে। দৃশ্যটি আমার কাছে খুব খারাপ লাগলো। কানে এলো- রিকশাওয়ালা লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘গরম বেশি পড়ছে দেইখা পাঁচটা টেহা বেশি চাইছি, মন চাইলে দিবেন; না চাইলে দিবেন না- মারবেন ক্যান?’

আসলেই তো, গরীব লোকটাকে পাঁচ টাকা বেশি চাওয়ার জন্য এতো নির্মমভাবে মারাটা কী যৌক্তিক? বিষয়টা সুন্দরভাবে মিটানো যেতো, অথচ তা না করে সবাই মিলে আরও বেশি করে অন্যায়টাকে উস্কে দিচ্ছে।

অথচ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মতে এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, দু’জন মুসলিমের মধ্যে বিবাদ হলে তা মিটিয়ে দিতে। তিনি আরও শিক্ষা দিয়েছেন ক্রোধকে সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে।

নবী করিম (সা.) আরও বলেছেন, যে কোনো অন্যায়-জুলুম হতে দেখলে তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করতে, মুখে প্রতিবাদ জানাতে, তাও সম্ভব না হলে- অন্তরে অন্যায় কিংবা অন্যায়কারীর প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে। আজ সেসব শিক্ষা থেকে মুসলিম সমাজ কতটাই না দূরে।

অথচ সুন্নতে রাসূল (সা.)-এর বাস্তব অনুসরণের সর্বাধিক তাগিদ রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। আর জীবনে সুন্নতের অনুসরণের মাঝেই রয়েছে কাঙ্ক্ষিত সফলতা।