ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ইসলামের এক মৌলিক শিক্ষা ও সৌন্দর্য্য
‘সহিষ্ণু’ শব্দের অর্থ বাংলা একাডেমির অভিধানে লেখা হয়েছে- সহনশীল, ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল, প্রতীক্ষাশীল। যার বিশেষণ হলো- সহিষ্ণুতা। এসব অর্থ পর্যালোচনা করলে ‘ধর্মীয় সহিষ্ণুতা’ বলতে বুঝায় ধর্মীয়ভাবে, ধর্মীয় কারণে কিংবা ধর্মীয় কোনো বিষয়ে অন্যের প্রতি সহনশীল হওয়া বা সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া। এটি অন্যকে, অন্যের মত, আদর্শ ও বিশ্বাসকে সহ্য করার ক্ষমতাও বটে।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ইসলামের অন্যতম একটি মৌলিক শিক্ষা ও সৌন্দর্য্য। গুরুত্বপূর্ণ এ মূলনীতি শুধু ইসলামকে সার্বজনীনতার স্বীকৃতি এনে দেয়নি বরং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাদুমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে।
ইসলামের সুমহান বাণী তাই সর্বস্তরের মানুষের কাছে যেমনি গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তেমনি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নিশ্চয়তা দিয়ে সামাজিক জীবনে এনে দিয়েছে শান্তি। ইসলামের দেখানো ধর্মীয় সহিষ্ণুতার উদাহরণ তাই যুগে যুগে অনুকরণীয়-অনুসরণীয়। অথচ বর্তমান বিশ্বের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সচেতন সবার বিবেককে তাড়া করছে। উপায় খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিবেকবান চিন্তাশীলরা। কিন্তু সেখানে উপেক্ষিত হয়েছে ইসলামের শিক্ষা।
ইসলামের প্রত্যেকটি বিধানের যেমন শরয়ি উদ্দেশ্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার মূলনীতি। এসব উদ্দেশ্য ও মূলনীতি না জানার কারণে অনেক সময় বিধানদাতা আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
ইসলামে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার উদ্দেশ্য অনেক। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো-
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন: ইসলামি বিধি-বিধানের মূল লক্ষ্য দুনিয়ার কোনো কিছু অর্জন নয় বরং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এক্ষেত্রেও সহিষ্ণুতার মূল উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কারণ, আল্লাহর বিধানই হলো- অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করা যতক্ষণ তা আল্লাহর একত্ববাদের সাংঘর্ষিক কিংবা অন্যকোনো মৌলিক বিধানের বিপরীত না হবে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘বলুন, হে আহলে কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে আসো যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবো না, তার সঙ্গে কোনো শরিক সাব্যস্ত করবো না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা বানাবো না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করে, তাহলে বলে দাও যে, সাক্ষী থাকো আমরা তো অনুগত।’ -সূরা আলে ইমরান: ৬৪
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসেও এর প্রত্যায়ন পাওয়া যায়। হজরত আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকে সে ঈমানের মিষ্টতা লাভ করে থাকে। আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) তার কাছে অন্য সব কিছু থেকে অধিক প্রিয় হবে। কাউকে ভালোবাসলে কেবল আল্লাহর জন্যই ভালোবাসবে। আর কুফরি থেকে তাকে আল্লাহর বাঁচানোর পর পুনরায় তাতে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করবে যেমন সে নিজেকে আগুনে নিক্ষিপ্ত করাকে অপছন্দ করে।’ –সহিহ বোখারি: ৬০৪১
সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা: শরয়ি দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার উদ্দেশ্য হলো- সামাজিক জীবনে একে অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা। এটি মোটেও এমন নয় যে, অন্য ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে মেনে নেওয়া বা নিজেকে সে অনুযায়ী পরিচালনা করা। বরং সে ধর্ম বা বিশ্বাসকে এজন্য সহ্য করা- যা তাদের জন্য প্রযোজ্য।
শুধু ধর্মীয় কারণে বা বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে কারও সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না- যা অসহিষ্ণুতা ও সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যায়। বিশিষ্ট ইসলামি স্কলার ড. জামাল বাদাভি বলেন, ‘মুসলিম-অমুসলিম সুসম্পর্কের মূল ভিত্তি ও উদ্দেশ্য হলো- শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ, ন্যায়পরায়ণতা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ...।’
ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করা: ধর্মীয় সহিষ্ণুতার উদ্দেশ্য হলো- ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করা। এটি এমন এক চেতনা, যাতে একে অন্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাকে অবশ্যাম্ভাবী করে তুলে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এ বোধ অনস্বীকার্য। কারণ, ইসলামি মূল্যবোধের শিক্ষা হলো- সমগ্র মানবজাতি এক পিতা থেকে এসেছে। যা কোরআনের সূরা আন নিসায় বলা হয়েছে। কোরআনে কারিমে আরও বলা হয়েছে, ‘এবং সে পিতার সকল সন্তানকে আল্লাহতায়ালা নিজেই সম্মানিত করেছেন অন্য সব সৃষ্টির ওপর।’ -সূরা আল ইসরা: ৭০
এখানে ভেদাভেদ করা হয়নি ভিন্ন ধর্ম, ধর্মীয় বিশ্বাস, মত, পথ ও আদর্শকে। এত যে ভিন্নতা এগুলো একে অপরের মধ্যে পরিচয়ের মাধ্যম। ‘তবে, সৃষ্টিকর্তার সামনে সম্মানিত সে, যে তাকওয়াবান।’ -সূরা আল হুজুরাত: ১৩
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মূলনীতি
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কিছু মূলনীতি আছে। তাছাড়া চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছা সম্ভব না। বস্তুত ইসলামের প্রত্যেকটি বিধানেরই মূলনীতি আছে। সেক্ষেত্রে কিছু মূলনীতি আছে যা অবশ্য পালনীয়। যেমন-
সামাজিক শান্তিই মূল ভিত্তি: সামাজিক শান্তিই হবে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মূল ভিত্তি। সমাজজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে ধর্ম ও বিশ্বাসের ভেদাভেদ ভুলে যেয়ে সংঘাত-সংঘর্ষকে উপেক্ষা করবে জীবনের প্রত্যেক পর্বে। ধর্ম ও বিশ্বাস সেখানে চালিকা হিসেবে কাজ করবে কিন্তু তার মৌলিকতায় কোনো ছোদ ঘটাবে না। সুতরাং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা হবে শান্তিপূর্ণ এক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে ধর্ম ও বিশ্বাসের কারণে কোনো রকম ঝগড়া-বিবাধ থাকবে না, থাকবে না কোনো অন্যায়-অবিচার। নিরাপত্তা পাবে সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু সবাই। ফলে শান্তিই হয়ে উঠবে জীবনের এক বাস্তব অধ্যায় হিসেবে।
উভয়ের পারস্পারিক সদিচ্ছা: সহিষ্ণুতা উভয় পক্ষ থেকেই হতে হবে। অর্থাৎ সহনশীলতা ও ক্ষমাশীলতার বহিঃপ্রকাশ একপক্ষ থেকে হলে হবে না। এটি এ জন্য যে, উভয়পক্ষই চায় সম্প্রীতি বজায় থাকুক এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হোক। একপক্ষ সহিঞ্চু হলেও অন্যপক্ষ্যের অসহযোগিতা সংঘাত-সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাবে এটাই বাস্তব।
নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা: ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নির্দিষ্ট লক্ষে হতে হবে এবং তা অবশ্যই সামাজিক বিষয়সমূহে হবে। এটি ধর্মের কোনো মৌলিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়ে হতে পারবে না। সেক্ষেত্রে উভয়ের পারস্পরিক বুঝাপড়ার মধ্যে সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা ও মানবাধিকারের বিষয়গুলোই এজন্য প্রাধান্য পাবে যে তারা নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ উদ্দেশ্যের ব্যতয় ঘটলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হবে।
উল্লেখ্য যে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসীর সঙ্গে নয় বরং এটি হতে পারে একই ধর্মের অনুসারীর ভিন্ন মতাবলম্বীর ওপর। কিন্তু এটি ততক্ষণ পর্যন্ত পালিত হবে যতক্ষণ একজনের ধর্ম, ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা কার্যাবলি অন্য কোনো ধর্ম, তার অনুসারী ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর জন্য ক্ষতির কারণ না হবে। ফলশ্রুতিতে সংঘাত, সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকে।
মোদ্দাকথা হলো- ইসলামি শরিয়তের বিধি-বিধানের উদ্দেশ্য ও মূলনীতি জানা থাকলে সে বিধান পালনে যেমন আগ্রহ তৈরি হবে তেমনি তা উপভোগ্য ও আনন্দদায়ক হবে- এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া নির্দিষ্ট লক্ষে পৌঁছতে সঠিক মূলনীতি জানা ও সে আলোকে তা পালন করা অত্যাবশ্যক।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক