ডাকসু’র সাবেক নেতারা কে কোথায়?
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নেতৃত্ব তৈরির আঁতুড়ঘর হিসেবে সুপরিচিত। মিনি পার্লামেন্ট খ্যাত ডাকসুতে নেতৃত্ব যারা দিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে দেশ ও জাতিরও নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা।
তাদের নেতৃত্বে সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে যেমন ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন আছে, তেমনি গণতন্ত্র আর জনগণের অধিকার আন্দোলনসহ স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনও রয়েছে। এই ডাকসুই রাজনীতির উজ্জ্বল তারকা তৈরির কারিগর। সেই সব ডাকসাইটে নেতারা এখনও জাতীয় রাজনীতিতে নিজ নিজ পরিচয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রেখে চলছেন।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক হিসেবে খ্যাত ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) তোফায়েল আহমেদ (১৯৬৮-৬৯) আজকে রাজনীতিতে বর্ষীয়ান ও জীবন্ত রাজনীতিক। বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ মোট সাতবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ সদস্যও (এমএনএ) নির্বাচিত হন। ডাকসু ভিপির নির্বাচিত হওয়ার আগে তোফায়েল আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) নির্বাচিত ভিপি ছিলেন ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে।
এরপর ডাকসু’র ভিপি নির্বাচিত হয়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিসহ ছয় দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফা দাবিতে পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানবিরোধী গণজাগরণ ও ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই ছাত্র ও গণআন্দোলনই ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। যার ফলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং আইয়ুব খানের পতন ঘটে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তোফায়েল 'মুজিব বাহিনীর' অঞ্চলভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার প্রধানের একজন ছিলেন। এছাড়াও স্বৈরশাসনবিরোধী গণঅভ্যুত্থানসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
১৯৬৩-৬৪ সালে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন 'অগ্নিকন্যা' নামে খ্যাত মতিয়া চৌধুরী। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থি রাজনীতি দিয়ে। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মতিয়ার চৌধুরীর সমকালীন আরেক বামপন্থি রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন ডাকসুর ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি। জোট-মহাজোট সরকারের কয়েকবার মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন তিনি। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আদায়, সামরিক আইনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
দেশ স্বাধীনের পর ডাকসু নির্বাচন প্রথম ভিপি হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি দেশের অন্যতম বিশিষ্ট বামপন্থি রাজনীতিবিদ। বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি। স্কুলছাত্র থাকাকালেই ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিছিল করতে গিয়ে কারাবরণ করেন সেলিম। কলেজে পড়ার সময় সক্রিয়ভাবে বামপন্থি ছাত্র আন্দোলন ও রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেনন ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্বও পালন করেন।
আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর আখতারউজ্জামান ডাকসু’র ভিপি ও দুইবার জিএস পদে (১৯৭৯-১৯৮৩) আসীন হয়েছিলেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ সদস্য এবং গাজীপুর জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ডাকসু’র দুবারের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) জিএসের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় এই নেতা এসময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেও হেরে যান তিনি।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মেদ; ১৯৮৯-৯০ মেয়াদে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ মনসুর নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় অংশ নেন। এসময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারপন্থী তকমায় দল থেকে ছিটকে পড়েন।
এরপর ড. কামাল হোসেনের গণফোরামে যোগ দেন মনসুর। একাদশ জাতীয় নির্বাচন আগে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনেও অগ্রণী পালন করেন তিনি। নির্বাচনে গণফোরামের টিকিটে ধানের শীষ প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঐক্যফ্রন্টের একমাত্র সংসদ হিসাবে শপথ নিয়ে আবারও আলোচনায় আসেন তিনি।
ডাকসুর সর্বশেষ রাজমণি ছিলেন আমান উল্লাহ আমান। তিনি ১৯৯০ সালে ৬ জুন ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।তার নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত এবং দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। বর্তমানে বিএনপির রাজনীতির সম্পৃক্ত আমান; বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে রয়েছেন। তিনি কয়েকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ঢাকা থেকে।