উইন্ডিজকে উড়িয়ে বাংলাদেশের বদলা!
এই ম্যাচের ফল কি হতে যাচ্ছে সেই আভাষ মিলে ছিলো দ্বিতীয়দিনের শেষে। তৃতীয় দিনের সকালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফলোঅনে পড়ার পর স্পষ্ট হয়ে উঠে- ম্যাচে বড় ব্যবধানেই হারছে তারা। লাঞ্চের পর এই ম্যাচের তখন একটাই অপেক্ষা- কখন হারছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ!
সেই অপেক্ষা ফুরালো তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় সেশনে, চা বিরতির জন্য বাড়িয়ে দেয়া সময়ে। ইনিংস ও ১৮৪ রানে ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ ‘বদলার টেস্ট সিরিজ’ শেষ করলো ২-০ তে জিতে। বাংলাদেশের ৫০৮ রানের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ইনিংস শেষ হয় ১১১ ও ২১৩ রানে। ম্যাচে উভয় ইনিংস মিলিয়ে ১১৭ রানে ১২ উইকেট নিয়ে অফ স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ সেরা শিকারি। টেস্ট ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো এক ম্যাচে ১০ বা তার চেয়ে বেশি উইকেট পেলেন মেহেদি। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে এটি সেরা বোলিংয়ের নতুন রেকর্ড। আগেরটি ছিলো ১৫৯ রানে ১২ উইকেট। সেই রেকর্ডটিও গড়েছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজই, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৬ সালের অক্টোবরে। নিজের সেই শ্রেষ্ঠত্বকেই ঢাকা টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ছাড়িয়ে গেলেন মেহেদি মিরাজ। টেস্টে এটি বাংলাদেশের ১৩তম জয়। এই প্রথমবারের মতো কোন প্রতিপক্ষকে ইনিংসের ব্যবধানে হারালো বাংলাদেশ। টেস্টে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে এই সিরিজকে ‘বদলার টেস্ট সিরিজ’ এমন নামকরণ কেন করা হচ্ছে?
চলতি বছরের জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যায় বাংলাদেশ। সেই সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশকে হারায় ২-০ তে, একেবারে একতরফা ভঙ্গিতে! দুটি ম্যাচই উইন্ডিজ জিতে তিনদিনের মধ্যে। টেস্টে নিজেদের সর্বনিম্ন ৪৩ অলআউটের লজ্জাও সেই সিরিজে পেয়েছিলো বাংলাদেশ। দ্বিতীয় মেয়াদে টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে সাকিব আল হাসানের সেই সিরিজে বাংলাদেশ দাঁড়াতেই পারেনি। উড়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুরন্ত পেস বোলিংয়ের ঝড়ে।
নিজ মাটিতে এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেয়ে সেই হারের বদলা নিলেন সাকিব যেন গুনে গুনে! একেবারে যাকে বলে হিসেব চুকিয়ে দেয়া; সেটাই করে দেখালো বাংলাদেশ এই টেস্ট সিরিজে। তাও আবার বছর না ফুরাতেই, পাঁচমাসের মধ্যে হিসেব বরাবর করে দিলো বাংলাদেশ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটি থেকে টেস্ট সিরিজ এর আগেও জিতেছিলো বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২-০ তে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতেছিলো। ৯ বছর পর এবার নিজ মাটিতেইও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুঁড়িয়ে দিয়ে টেস্ট সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ।
চট্টগ্রামে সিরিজের প্রথম টেস্টে বাংলাদেশ জিতেছিলো ৬৪ রানে। ঢাকায় জিতলো পুরোপুরি একতরফা ভঙ্গিতে। ইনিংস ও ১৮৪ রানে জয়ের ব্যবধান তো বাংলাদেশের হয়ে সেই প্রমানই দিচ্ছে।
চট্টগ্রামের মতো ঢাকায়ও স্পিনেই বধ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের গড়া ৫০৮ রানের বিশাল রানের পেছনে ছুটতে নেমে সেই যে হোঁচট খেলো আর মুখ তুলে দাড়াতে পারলো না। দ্বিতীয়দিনের শেষ বিকালে ৭৫ রানে ৫ উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তৃতীয়দিনের সকালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে খুব বেশি কিছু করে ফেলবে এমন আস্থাও ছিলো না। যথারীতি সেই ধারণাকে সত্যি করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংস ধ্বসে পড়লো মাত্র ১১১ রানে। মেহেদি মিরাজ ৭ এবং সাকিব আল হাসান ৩ উইকেট নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংস শেষ করে দিলেন। এই ইনিংসে তাইজুল ইসলাম মাত্র এক ওভার বোলিংয়ের সুযোগ পান!
ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করতে নামা উইন্ডিজ ফের মহা সঙ্কটে পড়ে। লাঞ্চের আগেই তারা ৪ উইকেট হারিয়ে বসে। তারপরও এই ম্যাচ এতদুরে গেলো তার পুরো কৃতিত্ব শুধু একজনের-শিমরন হেটমায়ার। মিডলঅর্ডার এই ব্যাটসম্যান ভিন্ন কৌশল নিলেন। অনায়াসে যার নাম দেয়া যেতে পারে; ‘ছক্কা মিশন’! পাল্টা আক্রমন বেছে নিলেন। সাকিবকে এক ওভারেই হাঁকালেন তিন ছক্কা। ৯২ বলে তার ৯৩ রানের ইনিংসে ছক্কার শট ৯টি। বাউন্ডারি মাত্র ১টি। প্রশংসা পাওয়ার মতো ইনিংস। তবে তার সেই চেষ্টা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ বাঁচাতে পারেনি; শুধু হারের সময়কে একটু দীর্ঘ করেছে।
প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও মেহেদি মিরাজের স্পিনেই কাটা পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ইনিংসে তার শিকার ৫৮ রানে ৭ উইকেট। দ্বিতীয় দফায় ৫৯ রানে ৫ উইকেট। ম্যাচে ১২ উইকেট পাওয়া মেহেদি মিরাজ ছিলেন এই টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের সামনে আনপ্লেয়েবল! সাদমানের চমৎকার অভিষেক। সাকিবের অলরাউন্ড নৈপূন্য। মাহমুদউল্লাহর চৌকষ ব্যাটিং। লিটনের আনন্দদায়ক হাফসেঞ্চুরি। সব ছাড়িয়ে সব ছাপিয়ে ঢাকা টেস্টে অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজই ছিনিয়ে নিলেন স্পটলাইট!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: বাংলাদেশ ১ম ইনি: ৫০৮/১০ (১৫৩.৬ ওভারে, সৌম্য ১৯, সাদমান ৭৬, মুমিনুল ২৯, মিঠুন ২৯, সাকিব ৮০, মুশফিক ১৪, মাহমুদউল্লাহ ১৩৬, লিটন ৫৪, মিরাজ ১৮, তাইজুল ২৬, নাঈম ১২*, অতিরিক্ত ১৫, রোচ ২/৬১, লুইস ১/৬৯, চেজ ১/১১১, বিশু ২/১০৯, ওয়ারিক্যান ২/৯১, ব্রাফেট ২/৫৭)। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ম ইনি: ১১১/১০ (৩৬.৪ ওভারে, হেটমায়ার ৩৯, ডারউইচ ৩৭, সাকিব ৩/২৭, মিরাজ ৭/৫৮)। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২য় ইনি: ২১৩/১০ (ফলোঅনেক পড়ে ৫৯.২ ওভারে, হোপ ২৫, হেটমায়ার ৯৩, বিশু ১২, রোচ ৩৭*, লুইস ২০, মিরাজ ৫/৫৯, তাইজুল ৩/৪০, সাকিব ১/৬৫, নাঈম ১/৩৪)।
ফল: বাংলাদেশ ইনিংস ও ১৮৪ রানে জয়ী।
সিরিজ: ২ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-০তে জয়ী
ম্যাচসেরা: মেহেদী হাসান মিরাজ
সিরিজসেরা: সাকিব আল হাসান