নিউজিল্যান্ড ২৭ : বাংলাদেশ ০!
সিরিজ শুরুর আগে তিনি তেমন আলোচনার বিষয়ই ছিলেন না!
সেই তিনিই এখন একঅর্থে সিরিজের সবকিছু। এই তিনি নেইল ওয়েগনার। টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরিকে ছাপিয়ে চলতি টেস্ট সিরিজে এখন বোালিং পারফরমেন্সের শীর্ষে এই বাঁহাতি পেসার।
শুধু পারফরমেন্স নয়। ব্যতিক্রমী বোলিং কৌশল। প্রাণশক্তিতে ঠাসা শরীর। ওভারের প্রতি বলেই সমান শক্তি খরচ। ব্যাটসম্যানদের পেটে প্রজাপতির নাচন তৈরির আগাম বার্তা দেয়া। একের পর এক শর্ট বল করে যাওয়া। নিয়ম মেনেই বাউন্সার ঠোকা। ব্যাটসম্যানের চিবুক ঘেঁষে বল রাখার সক্ষমতা। পাঁজর টার্গেট করে বোলিং করার দক্ষতা। একটা দুটো বল নয়। টানা ওভারের প্রতি বলেই এই একই কৌশল! নেইল ওয়েগনারের সেই প্রভাবী বোলিংয়ের কোন জবাবই খুঁজে পাচ্ছে না বাংলাদেশ।
তামিম ইকবাল, লিটন দাসের পর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও স্বীকার করলেন ওয়েগনারের বল সামাল দিতে না পারাই চলতি সিরিজে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। হ্যামিল্টন টেস্টের পর ওয়েলিংটনেও সেই এই সঙ্কটে কাটা পড়লো বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ।
এমন নয় যে ওয়েগনারের চেয়ে ভাল বা দক্ষ ফাস্ট বোলারের বিপক্ষে বাংলাদেশ আগে কখনো খেলেনি। খেলেছে। এবং বিশ্বমানের সেই ফাস্ট বোলারদের বিপক্ষেও সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
কিন্তু ওয়েগনার এক এমন বোলিং অস্ত্র নিয়ে আসছেন যে তাকেই খেলাই যাচ্ছে না। উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসতে হচ্ছে!
অবাক করার বিষয় হলো ওয়েগনার কি ধরনের বল করবেন সেটা কিন্তু তিনি বোলিং মার্কে দৌড় শুরুর সময়ই ব্যাটসম্যানরা বুঝে যান! তাও যে সমাধান মিলছে না। মুলত জোরে শর্ট পিচ বল করা এবং বাউন্সার ঠুকে দেয়াই ওয়েগনারের বোলিংয়ের মুল কৌশল বা ধার। ক্রিজে দাড়ানো ব্যাটসম্যান জানেন যথারীতি আরেকটি শর্ট পিচ বল আসছে। হয় কাঁধ সমান। নয় চিবুক কাঁপিয়ে যাবে। নয়তো বা টার্গেট পাঁজর! তবে ওয়েগনারের এই বোলিংকে ‘বডিলাইন’ বলার উপায় নেই। বলের লাইন ও লেন্থ এমনই যে বেশিরভাগ সময় ব্যাটসম্যানকে সেটা বাধ্য হয়েই খেলতে হবে। ব্যাট উঁচিয়ে সব সময় ছেড়ে দেবেন, বা মাথা নুইয়ে সমঝোতা খুঁজবেন-এমন উপায় নেই। হাতে ধরা ব্যাটের ব্যবহার করতেই হবে, এমন লেন্থে বল রাখেন ওয়েগনার। তাও আবার ১৪০ কিলোমিটার বেগে আসা বলে। ব্যাক অব লেন্থ থেকে উঠে আসা সবগুলো ডেলিভারিই তার নিখুঁত প্রায়!
ওয়েগনারের বল আপাতত তিনটি কৌশলে খেলেছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। প্রথমত: একটু বাইরে থাকা বল ব্যাট উঁচিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত: ধেঁয়ে আসা বল থেকে শরীর বাঁচাতে ব্যাটকে রক্ষাকবচ বানিয়েছে। তৃতীয়ত: হুক বা পুল শটে রান তোলার চেষ্টা করেছে।
এই তিন কৌশলের শেষের দুটোতে বেশিরভাগ সময় শেষ হাসি হেসেছেন নেইল ওয়েগনার। শরীর বাঁচাতে ব্যাট সামনে নেয়ায় বল গøাভসে বা ব্যাটের কানায় লেগে শর্ট লেগে ক্যাচ হয়েছে।
এমন ভঙ্গির আউটের উদাহরণ দেখতে চাইলে ওয়েলিংটনের দ্বিতীয় ইনিংসে তাইজুল ইসলামের আউটের রিপ্লেটা দেখে নিতে পারেন আপনি। হুক বা পুল করতে গিয়ে ব্যাটসম্যানরা ক্যাচ তুলে ফিরেছেন এমন নজির একটা দুটো নয়, অনেক।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাড়ালো? ওয়েগনারকে ব্লক করাও যাচ্ছে না। আবার মেরে কেটে খেলাও যাচ্ছে না! মাঝখান থেকে তিনি টপাটপ উইকেট উপড়ে নিচ্ছেন। ২ টেস্টে ১৬ উইকেট শিকারি ওয়েগনারের বোলিং এখন বাংলাদেশের জন্য আর্টসের ছাত্রের কাছে ক্যালকুলাসের জটিল ফর্মুলা যেন!
ওয়েগনারের বোলিংয়ে বাংলাদেশের ব্যর্থতার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাখাটা এমন-‘দোটানায় পড়ে শটস খেলছি আমরা। বেশিরভাগ শটস হয়ে যাচ্ছে হাফহার্টেট। নিজের কৌশলে কমিটেড থাকতে পারছি না আমরা।’
অর্থাৎ ছাড়বো, খেলবো না মারবো-এই ত্রয়ী চিন্তায় ব্যাটিং ভজঘট!
ব্যাটসম্যানের সমালোচনা তো হলো, এবার একটু নেইল ওয়েগনারের প্রশংসাও করি! একই গতিতে, একই কায়দায়, প্রায় সমশক্তিতে টানা স্পেলে এমন ব্যাক অফ লেন্থে বল করতে গিয়ে ওয়েগনারকে প্রচুর পরিমান শক্তি খরচ করতে হচ্ছে। ওভারে দুটোর বেশি বাউন্সার ঠোকার নিয়ম নেই টেস্ট ক্রিকেটেও। তিনি ভালই জানেন উচ্চতায় একটু এদিক-ওদিক হলে আম্পায়াররা নো বল ডাকবেন। বডিলাইন বোলিংয়ের অভিযোগও উঠতে পারে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত চলতি সিরিজে আম্পায়াররা তার কোন বলেই আপত্তি বা সমস্যা খুঁজে পাননি। সমস্যার যা, তার পুরোটাই শুধু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিংয়েই!
টেস্ট ক্রিকেট দস্তরখান বিছিয়ে মেহমানদারির বিষয় নয়, নিউজিল্যান্ড সফরে সেটা আরেকবার বুঝলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। এই লড়াইয়ে টিকতে হলে দক্ষতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
খেলাটার নামই যে টেস্ট ক্রিকেট-পরীক্ষা! পারলে পাস, না পারলে ফেল! ফল;একই শ্রেণীতে অনেক বছর!
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ আপাতত ক্রিকেটের তেমনই ছাত্র; ব্যাকবেঞ্চার! রিপোর্ট কার্ড তো তাই জানাচ্ছে। দেড়যুগ আগেও নিউজিল্যান্ডে বৃষ্টিতে দুদিন ধুঁয়ে যাওয়া তিনদিনের টেস্ট ম্যাচ বাংলাদেশ হেরেছিলো সোয়া দু’দিনে। দেড়যুগ পরেও সেই একই কাহিনী। একই শ্রেণীতে আটকা!
ফুটনোটঃ নিউজিল্যান্ড ২৭ ঃ বাংলাদেশ ০! নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সব ফরমেটে বাংলাদেশের রেকর্ডটা এখন এমনই!