কোন নাট্যকার লিখেছিলেন এমন ফাইনালের স্ক্রিপ্ট?
ফিকশন অনেকেই লেখেন। দুনিয়ার সেরা ফিকশন লেখা কোনো নাট্যকারকেও যদি লর্ডসের ফাইনাল নিয়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ কোনো স্ক্রিপ্ট লিখতে দেয়া হতো, তাহলে কি হতো?
নিশ্চিত থাকতে পারেন-তিনিও এমনকিছু লিখতে পারতেন না, যে ফিকশনের দেখা মিললো ১৪ জুলাইয়ে সন্ধ্যায় লর্ডসে!
ক্রিকেটীয় সব উত্তেজনার উত্তুঙ্গকে হার মানিয়েছে বিশ্বকাপের এই ফাইনাল। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসের সেরা দুটি শেষ ওভারের দেখা মিললো লর্ডসের ফাইনালে।
পাগল পারা হাসি আনন্দ। প্রায় হেরে বসা ম্যাচ জিতে ফেরা। এতো কাছে এসেও জিততে না পারা। শেষ ওভারে জোড়া রান আউট। অনেক আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাওয়া ডিফ্লেকশন থেকে পাওয়া বাউন্ডারি। সুপার ওভারে ছক্কা। শেষ বলে সুপার থ্রো। দুর্দান্ত রানআউট। সুপার ওভারও টাই! ম্যাচে বাউন্ডারি বেশি থাকায় ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন। মারটিন গাপটিলকে রান আউট করার পর আর থার্ড আম্পায়ারের অপেক্ষায় থাকলেন না জস বাটলার। সঙ্গে সঙ্গে গ্লাভস খুলে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। বোলার জোফরা আর্চার উইকেট পাওয়ার পর ইমরান তাহিরের মতো দুই হাত প্রসারিত করে ছুটলেন লর্ডসের ড্রেসিংরুমের দিকে! পুরো ইংল্যান্ড দল জস বাটলারকে চেপে ধরলো। চললো জড়াজড়ি। কোলাকুলি। পাগলপারা আনন্দ-উল্লাস।
একপ্রান্তে যখন এই আনন্দ-হাসি খেলা। ঠিক তখনই উইকেটে আরেকপ্রান্তে ব্যাট হাতে হাঁটু গেড়ে বসে পাথুরে মুর্তির ভঙ্গিতে মারটিন গাপটিল। তার রানআউটেই যে নিউজিল্যান্ড হেরে গেলো বিশ্বকাপ ফাইনাল। ইস সোধি ও জেমস নিসাম এসে পিঠে হাত রেখে তাকে সান্ত¦না দিচ্ছেন। ইংল্যান্ডের ক্রিস ওকসও সমবেদনার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন-‘উঠো বন্ধু, এটা নেহাৎ একটা ক্রিকেট ম্যাচ। জীবন আরো অনেক বড়ো।’
কিন্তু সেই সান্ত¦নায়ও কি চোখের জল লুকাতে পারলেন মারটিন গাপটিল? লর্ডসের সন্ধ্যায় ম্যাচের শেষ বলে দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখী মানুষ মনে হলো তাকে!
ম্যাচটা যখন শেষ ওভারে গড়ায় তখন জেতার জন্য ইংল্যান্ডের প্রয়োজন দাড়ায় ১৫ রানের। বেন স্টোকস উইকেটে থাকলেও প্রথম দুই বলে কোনো রানই এলো না। নিশ্চিতভাবে তখন ম্যাচে এগিয়ে নিউজিল্যান্ড। কিন্তু তৃতীয় বলে ছক্কা হাঁকিয়ে বেন স্টোকস জানিয়ে দিলেন-বিশ্বকাপ ফাইনালে ট্রফিটা নিয়ে যেতেই এসেছেন তিনি। পরের বলে ডাবল রান। কিন্তু দ্বিতীয় সেই রানটা ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। মিডউইকেট থেকে বলটা ধরে থ্রো করলেন মারটিন গাপটিল। রানআউট থেকে রক্ষা পেতে বেন স্টোক উইকেটের কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঠিক তখনই গাপটিলের উড়ে আসার বলটা বেন স্টোকের ব্যাটের কানায় লাগে বাউন্ডারি দিকে ছুটে। দুই পাশে আত্মসপর্নের ভঙ্গিতে হাত প্রসারিত করে স্টোকস জানান-এটা অনিচ্ছাকৃত। দৌড়ে দুই রান। আর ডিফ্লেকসন হয়ে মিললো চার রান, মোট ছয়! টানা দুই বলে ছয়। ঝপাৎ করে বদলে গেলো ম্যাচ পরিস্থিতি। শেষ ২ বলে ম্যাচ জিততে ইংল্যান্ডের চাই তখন মাত্র ৩ রান। পঞ্চম বলে সিঙ্গেল রান নিলেন স্টোকস। কিন্তু স্ট্রাইক নিজের হাতে রাখতে ঝুঁকিপূর্ণ দ্বিতীয় রানের জন্যও দৌড়ালেন। স্টোকস ঠিকই পৌছালেন নিজের প্রান্তে। কিন্তু আদিল রশিদ রান আউট হয়ে গেলেন।
শেষ বলে ২ রান নিলেই বিশ্বকাপ ইংল্যান্ডের। এবারো প্রথম রানটা ঠিকই নিলেন স্টোকস। কিন্তু দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে মার্ক উড রান আউট! স্কোর তখন দু’দলের সমান; ২৪১ রান!
ম্যাচ টাই।
এর পর সুপার ওভারের নাটক। স্টোকস ও জস বাটলার সুপার ওভারে ১৫ রান করলেন। ম্যাচ জিততে এবার নিউজিল্যান্ডের টার্গেট দাড়ালো ১৬ রান। শুরুর তিন বলেই ১১ রান মিললো। শেষ তিন বলে প্রয়োজন মাত্র ৫ রান। চতুর্থ বলে ফের ডাবল রান। পঞ্চম বলে জেমস নিসাম নিলেন সিঙ্গেল। ওভারের শেষ বলটা খেলার দায়িত্ব পড়লো মারটিন গাপটিলের ওপর। আর্চারের বলটা মিড উইকেটে শটস খেলে গাপটিল প্রথম রানটা নিলেন। দ্বিতীয় রানের জন্য দৌড়ালেন। কিন্তু জেসন রয়ের নিখুঁত থ্রো জমা হলো জস বাটলারের হাতে। স্ট্যাম্প ভেঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়লেন বাটলার। গাপটিল রানআউট। থার্ড আম্পায়ারের কাছে সিদ্ধান্ত আসার আগেই ম্যাচ জয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা।
সুপার ওভারে স্কোর সমান। কিন্তু মুল ম্যাচ এবং সুপার ওভার মিলিয়ে বাউন্ডারি হাঁকানোয় এগিয়ে থাকায় বিশ্বকাপের নতুন চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। চার বছর ধরে যে এই বিশ্বকাপ জয়ের যে স্বপ্ন দেখছিরো ইংল্যান্ড-তা সত্যি হলো হোম অব ক্রিকেটে।
তাও আবার কিভাবে-সুপার ওভারের টাইয়ে!
বিশ্বকাপ ফাইনালের মুল ম্যাচের শেষ ওভার এবং সুপার ওভারে যা ঘটলো তাতে শেষে এসে নিউজিল্যান্ডের হৃদয় ভাঙ্গলো। বিশ্বকাপ এলো ইংল্যান্ডের ঘরে। আর সত্যিকার অর্থে জয় হলো ক্রিকেটের!
গাপটিলের পিঠে ক্রিস ওকসের সান্তনার হাত তো তারই প্রমাণ!
লর্ডসের ফাইনালে উন্মুক্ত প্রেস বক্সে বসে ২২ গজের লড়াইয়ে কি দেখলাম-ক্রিকেট ম্যাচ? ক্রিকেট ফ্যান্টাসি? নাকি ক্রিকেট ফিকশন?
উত্তর মিলল-তিনটাকে যোগ করলে যা হয়, ফাইনালটা তাই!
আরও পড়ুন-