স্মৃতিমেঘ হয়ে আছেন সাংবাদিক মোস্তাক হোসেন
সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক মোস্তাক হোসেনের ডাকনাম ছিল লাবু। কাছের লোকজন ছাড়া এ নামটি সাধারণ মানুষের অজানা। নিজের ডাকনামটির মতো জীবনের অনেক কিছুই আড়ালে রেখে চির প্রস্তানের পথে চলে গেলেন তিনি সোমবার (৩ আগস্ট)। পাঁচ দশকের জীবনের পথরেখায় টেনে দিয়ে গেলেন যবনিকার কালো পর্দা।
আশির দশকের শুরুর দিকে প্রায়-প্রত্যহই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। ঢাকার দিনগুলোতে তখন এরশাদের তীব্রতর স্বৈরশাসনের প্রকোপ। অবাক হয়ে দেখেছি, সেই সঙ্কুল সময়েও তিনি আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর কথা অকপটে ও উচ্চকণ্ঠে বলছেন। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন নিজের বিশ্বাসের প্রতি সৎ এবং তা প্রচার ও প্রসারে সাহসী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা আর লেখালেখির সুবাদে অনেকের মতো তার সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ঢাকার সাংস্কৃতিক ভূগোল ও লেখার জগৎ তখনো এতো স্ফীত ও প্রসারিত হয় নি। সবাই সবাইকে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে চিনতেন। কথায় বরিশালের টান আর ভাসা ভাসা চোখের মোস্তাক হোসেনকে না চেনার কোনও সুযোগই ছিল না।
শুধু চেনা নয়, তার সঙ্গে নিবিড় নৈকট্য হতেও সময় লাগে নি। প্রাণখোলা কথা-বার্তার জন্য তিনি ছিলেন সঙ্গী-সহকর্মীদের প্রিয়। আওয়ামী লীগে তার অনেক সোর্স ছিল। বহু খবর আগাম জানিয়ে দিতেন তিনি। তার সঙ্গে খবরের সন্ধানে একাধিক বার ইস্কাটনে আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমুর বাসায় গিয়ে সাদরে আপ্যায়িত হয়েছি। বরিশালের প্রায়-সকল নেতাই তাকে আপন মনে করতেন।
আমার সঙ্গে নিবিড়তার দিনগুলোতে তিনি আজকের কাগজে যুক্ত হন নি। বিচিত্রা, রোববারে কন্ট্রিবিউট করেন। সাপ্তাহিক কাগজ, বিচিন্তায় লেখালেখি করেন। তাকে ঘিরে আরও পরিচয় হয়েছিল বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী, আসে দিন যায় সম্পাদক, গল্পকার আনোয়ার শাহাদত, বর্তমানে যুগান্তরের সাংবাদিক এনাম আবেদিন, বাম রাজনীতিবিদ-কবি (ডা.) ফয়জুল হাকিম লালা এবং আরও বহুজনের সঙ্গে।
কাছে লোকজনের সঙ্গে আড্ডায় রাজনীতির নানা কথা হতো। আমীর হোসেন আমু, বরিশাল আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন, রুহুল আমিন হাওলাদারের প্রসঙ্গ চলে আসতো। জাতীয় রাজনীতির সমান্তরালে তার মানসপটে বরিশালের ছিল উজ্জ্বলতম উপস্থিতি।
নদীবহুল, প্রকৃতি-নিবিড় বরিশালের ভৌগোলিক কারণেই হয়ত মোস্তাক হোসেনের মধ্যে একটি অপ্রকটিত রোমান্টিক দ্যোতনা খুব কাছে থাকলে টের পাওয়া যেতো। ক্লিন শেভ আর মাঝারী গড়নের নাগরিক জীবনের পেশা ও ব্যস্ততায় সেই অদেখা মোস্তাক হোসেনকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। কখনো কখনো অন্তরঙ্গ আলোকের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিগত আবেগ ও নিজস্ব সারল্যের উদ্দামতায় তিনি উন্মোচিত হতেন। বরিশালের নদী, পথঘাট, পাড়া, জলাভূমি ছাপিয়ে এক প্রেমিক পুরুষের উন্মাতাল ঘোরে তিনি তখন দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াতেন। সেই ঘোরাক্রান্ত সময়ে সব কিছু ছাপিয়ে মুন্নী নামের কোনও একজনের জন্য তার বুকভরা ভালেবাসা উছলে উঠতো।
জীবনে যেমন, মরণেও তেমনি অনেক প্রত্যাশার হাহাকার ও অন্তর্গত বেদনা কখনোই কাউকে বুঝতে না দিয়ে আড়াল করেই রেখেছেন তিনি। জীবনের স্মৃতিগুলো ঠিকই সন্তর্পণে সঙ্গে করে নিয়ে চিরদিনের মতে চলে গেছেন। একেবারেই চলে গেছেন তিনি চির অন্তরালের গহীন গোপন মৃত্যুর প্রদেশে।
আসলেই কি চলে গেছেন? নাকি কোনও কোনও সংবাদপত্র অফিসে অথবা কোনও কোনও লেখায় কিংবা কারো নস্টালজিয়ার একান্ত প্রান্তরে রয়ে গেছেন তিনি?
অমোঘ মৃত্যুতেও শরতের ছোপ-ছোপ নীল-রঙা স্মৃতিমেঘ হয়ে রয়েছেন সাংবাদিক মোস্তাক হোসেন। এই শরতে তার মৃত্যুতে বেদনার্ত হয়েছে বন্ধু-স্বজনদের মনের আকাশ। মৃত্তিকার সুগভীরে চিরঘুমে শায়িত মোস্তাক হোসেন অধরা মেঘে মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছেন আমাদের স্মৃতির আকাশে।