আধা রম্য: আমরা কারা এই আমজনতা?
সম্প্রতি ঢাকা থেকে ফেনী যাচ্ছিলাম। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কয়েক কিলোমিটার পরপরই তীব্র যানজট। বাসের শেষ সিটে বসে গরমে ঘামছি। যেমন তেমন হোক বাসে যে জায়গা পেয়েছি- এইতো বেশি; যেখানে সায়েদাবাদে বাসই পাচ্ছিলাম না। কুমিল্লার গৌরিপুর পার হওয়ার পর গাড়ির জট কিছুটা কমে আসে। এবার বাসচালকের বেপরোয়া গতি। সাপের মতো এঁকেবেঁকে গাড়ি চলছে। এই বুঝি পাশের গাড়িতে লাগে লাগে তখনই আবার হেঁচকা টানে বাসের মুখ ঘুরিয়ে টান দেয় চালক। রীতিমতো ভয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমজনতা হিসেবে আমি চিৎকার দিয়ে উঠি। সাবধানে চালাতে বলি। হায়! বাসের চুপ করে থাকা যাত্রীরা ছাড়া অন্যসব আমজনতা যাত্রী আমাকে শান্ত হয়ে বসতে বলেন।
আমার পাশের যাত্রীই আমাকে বললেন, এতোক্ষণ যানজটে থাকার পর এখন জোরে না টানলে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে পারবো না। জবাবে বললাম, বাড়ি দরকার হলে ২ ঘন্টা পর পৌঁছান, এর চেয়ে নিরাপদে পৌঁছানোটাই জরুরি। আমার কথা আমলেই নিলেন না। আরেকজন বললেন, কোনো চালকই ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটায় না। জবাবে বললাম, ইচ্ছে করে তারা দুর্ঘটনা ঘটান না, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তারা অনিয়ন্ত্রিত গতির কারণে গাড়ি সামলাতে পারেন না। আর দুর্ঘটনার গাড়িগুলোতো কোনো না কোনো চালকই চালান!
যাত্রীকূলের কেউ আমাকে পাত্তা দেন না। বরং গাড়ি চালানোর সময় চালককে বিরক্ত না করতে আমাকে অনুরোধ করেন। অবাক হই! আমি এবং এই যাত্রীরাইতো আমজনতা! যারা কিনা কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বৈঠকে, চায়ের আড্ডায় বা রাজপথে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলাম। এই কি তবে আমজনতার হাল!
নাহ! এরা আমজনতা নয়, এরা গুটিকয়েক। এই সান্ত্বনা নিয়ে নিজেকে বোঝাই। মহাখালী থেকে গুলশানের পথে বাইক চালিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়। বলা নেই- কওয়া নেই, পথের মাঝে বাস থেমে যায়। যাত্রী ওঠেন-নামেন। একদিন বাসের দরজার সামনে বাইক থামিয়ে নেমে যাওয়া একযাত্রীর কাছে জানতে চাইলাম, এটা কি আপনার নামার জায়গা? আমার কাছে ওই ভদ্রলোক উল্টো জানতে চাইলেন, আপনে জিজ্ঞাসা করার কে? এইতো আমজনতা! আমিও আমজনতা, যে কিনা মাঝে-মাঝে যানজট এড়াতে ফুটপাতের ওপর মোটর সাইকেল তুলে দেই আর বাসযাত্রীসহ পথের সকল পথচারীদের গুষ্ঠি উদ্ধার করি! মনে মনে আফসোস করে বলি, এরা কেউই যে কেন নিয়ম মানে না! দূরে পুলিশ দেখে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে আসি- আর দেশের সড়ক ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা করি, পারলে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করি।
আমাদের এই আমজনতার সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- আমরা অতি সাধারণ মানুষ! আমরা দেশের চিকিৎসা সেবার বদনাম করি, ডাক্তারের হাতে ডাকাতের মতো দেশি ধারালো অস্ত্র দেখি, প্রশাসনকে গালি দেই, পুলিশ দেখলেই মনে করি ঘুষ খেতে জিহবা বের করে রেখেছে, বাস আর ট্রাক চালকদের দেখলেই মনে করি নেশাগ্রস্ত, আমরা উকিলদের দেখলেই ভাবি- এই লোক কোনোদিন সত্য বলেনি, সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হলেই তার গায়ের সব পোশাক আমরা হলুদ দেখি, আমরা রিকশাওয়ালাকে দেখলে ছোট লোক বলি, বাজারে গেলে বিক্রেতাদের দিকে তাকালে মনে করি কিছু অর্থ পিপাসু বসে আছে লাউ, মাছ বা কাঁচা মরিচ নিয়ে।
আমরা অতি সাধারণ এই আমজনতা এসব ব্যবস্থার রাতারাতি অবসান চাই। আমরা চাই সমাজের সব সুন্দর হবে। আমরা শহীদ মিনারে বসে বাদামের খোসা ফেলবো আর পাহারা দেব কেউ যেন জুতা পায়ে মিনারের বেদিতে উঠতে না পারে!
এসব ব্যবস্থার পরিবর্তন চাওয়া এই আমাদের পেশা কি? আমরা সাধারণ পেশার মানুষ। আমরা অতি সাধারণ স্কুল শিক্ষক- যিনি চিকিৎসকের কাছে যেয়ে ভালো চিকিৎসা সেবা পানা না। আমরা রোগীর প্রতি দরদী ডাক্তার- যাদের বিরুদ্ধে শুধু শুধু সাংবাদিকরা মিথ্যা কথা লিখে বেড়ায়। আমরা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক- যাদের পদে পদে পুলিশ হয়রানি করেন। আমরাই সৎ পুলিশ অফিসার- যাদের পান থেকে চুন খসলে বদলি করে দেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। আমরাই সেই নির্লোভ প্রশাসনিক কর্মকর্তা- যাদেরকে হয়রানি করেও ক্ষান্ত হন না আইনজীবীরা। আর আমরাই সেই সত্যবাদী আইনজীবী- যার সন্তান শিক্ষকের কাছে টিউশনি পড়েনি বলে স্কুলের পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া হয়েছে।
আমরাই গরিব যার পেটে লাথি মারে বড়লোকেরা। আমরাই বড়লোক যাকে সুযোগ পেলেই রিকশাওয়ালারা ঠকায়। আমরাই বাদাম থেকে শুরু করে জাহাজের ব্যবসায়ী আবার আমরাই সব অর্থলিপ্সু ব্যবসায়ীর অফিসের শোষিত কর্মচারী।
আমাদের এই আমজনতাদের আরও অগণিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমাদের মতো সৎ, সাহসী, নির্ভীক মানুষের অবশ্য এতো পেশা, আশা, নেশা বা বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত নয়। তবে মধ্যবিত্ত প্রধান এই রাষ্ট্রে আমরা আমরাইতো। আর এই কারণেই কার্ল মার্ক্সও মধ্যবিত্তকে নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগেছেন। আর প্লেটো ক্ষমতার উৎস হিসেবে জনতাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন। কারণ আমজনতা মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি লোভাতুর দল, যারা পরিবর্তনকে ভয় পায়; যাদের মেধার বিকাশের চেয়ে সমালোচনা করার বিকাশ হয় ভালো।
নাহ্! আমরা আমজনতা এতোটা দ্বৈত চরিত্রেই নই। ইদানীং ঢাকার কিছু সড়কে আমজনতার পরিবর্তন এসেছে। গুলশানের সড়কগুলোতে কিন্তু এখন অনেককেই জেব্রা ক্রসিং মেনে সড়ক পার হতে দেখা যায়। আমরা এই আমজনতাই বাজারে ভেজাল খাদ্য বিক্রি করে ঘরে এসে নিজের সন্তানকে কোলে তুলে খেলা করতে থাকি। আমরা আমজনতা সবই পারি!