শীত আসছে হিমেল পরশে
টুপটাপ বৃষ্টি ঝরছে। স্বাভাবিক বৃষ্টি নয়, ভারি কুয়াশার মতো একটি দু’টি ফোটা। সকালের আলো-অন্ধকারের বুক চিড়ে নামছে চরাচরে। বাতাসে শীতের টান। এই ধরনের বৃষ্টি শীত আনবে। জীবনানন্দ দাশের কবিতার পথ ধরে পৌষের সন্ধ্যায় চলে যাবে প্রকৃতি। তখন কাব্যভাষায় বলা যাবে, ‘আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়।’
শুধু আমাদের দেশেই নয়, শীত এখন ক্রমে ক্রমে আচ্ছন্ন করেছে প্রায়-সারা পৃথিবীকে। উত্তর গোলার্ধে বরফপাতের ঘটনা ঘটছে। এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বরফাচ্ছন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে ইংল্যান্ডে। কানাডা-আমেরিকা-জার্মানির অনেক জায়গায় তাপমাত্রা নামছে। এশিয়ায় এসে হানা দিয়েছে শীত। কড়া নাড়ছে পূর্বপ্রান্তের দেশ জাপানে।
বাংলাদেশেও চলছে শীতের প্রস্তুতি। যদিও নগরায়নের দাপটে আর যান্ত্রিক উত্তাপে শহরের দিকে উষ্ণতার ছাপ রয়েছে, তথাপি শহর পেরিয়ে গ্রামের দিকে শীতের আলতো ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে। ভোরের দিকে শরীরে স্পর্শ দিচ্ছে হিম হিম ভাব। সন্ধ্যার দিগন্ত ছেয়ে আসছে হালকা কুয়াশার চাদরে।
শীতের পোশাক রোদে দেওয়ার দিন এখন। তুলে রাখা শীতবস্ত্র, লেপ-তোষক রোদের স্পর্শে উষ্ণতায় ভরে তুলতে চলছে প্রস্তুতি। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে শীত ঋতুকে বর্ণিল আমেজে উৎসবমুখরতায় উপভোগ করে মানুষ। মানুষের জীবনে বারো মাসে তেরো পার্বণের সঙ্গে ঋতুবৈচিত্র্যের যথেষ্ট যোগ রয়েছে। কিন্তু সেই বৈচিত্র্য যেন কোথাও ভাটা পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তন এবং নানাবিধ নাগরিক ব্যস্ততায়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই বেশ কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জোরালো আলোচনা হচ্ছে। কয়েক বছর আগেই সমুদ্রস্রোতের অস্বাভাবিক পরিবর্তনে-সৃষ্ট ‘এল নিনো’র ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ুর বিচিত্র পরিবর্তন সকলকেই ভাবিয়েছে। ‘এসিড বৃষ্টি’, ‘ওজন স্তর’ ক্ষয় ইত্যাদি এখন বিশ্ব আবহাওয়ার আলোচিত বিষয়।
আবহাওয়াবিদরা দেখেছেন যে, অসময়ের প্রবল বৃষ্টি, খরা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, প্রচণ্ড শুষ্কতা, দাবদাহ ইত্যাদি কারণে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে; শীতের ওঠা-নামা স্বাভাবিক হিসাবের বাইরে চলে যাচ্ছে। পৃথিবীর জলবায়ুর এই বিচিত্র ব্যবহারের কার্যকারণ খোঁজার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি প্যানেলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। দীর্ঘ গবেষণার পর সেই প্যানেল একবাক্যে জানিয়েছে, এ পরিবর্তন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে হচ্ছে না। শিল্প বিপ্লব ও অতি যান্ত্রিকীকরণের ফলে উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। আর এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রাগত ভারসাম্য। তাই ঘটছে জলবায়ুর পরিবর্তন। বর্ষা, শীত, গ্রীষ্ম স্বাভাবিক আচরণ করতে না। নানা রকম অস্বাভাবিকতায় চারপাশ আলোড়িত হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর আবহাওয়া, পরিবেশ ও প্রকৃতি সব সময় একই রকম থাকবে, এমনটি ভাবা উচিত নয়। এ বিশ্ব জগতের কোনো কিছুই স্থির নয়। বরং ধীর লয়ে হলেও পরিবর্তনশীল। আমরা টের পাচ্ছি না বটে, তথাপি আমাদের আবাসস্থলও পরিবর্তনের মাঝ দিয়েই চলছে। এই পরিবর্তন কতক প্রাকৃতিক আর কতক আমাদের ভুলের ফলে সৃষ্ট। তাই কিছু পরিবর্তন ভালো আর কিছু পরিবর্তন মন্দ। বিপদ তখনই নেমে আসে, যখন খারাপ পরিবর্তনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বিপদের প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের মতো ব-দ্বীপ অঞ্চল, যারা পাহাড় ও সমুদ্রের সন্নিকটবর্তী, তাদের ভাবনার মাত্রাটি আরও গভীর। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাহাড়ের বরফ গলে কিংবা সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে এই তটবর্তী দেশগুলোতে নানাভাবে বিপর্যস্ত করবে। কিছু কিছু কু-প্রভাব তো এখনই দেখা যাচ্ছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ চরম ও প্রলম্বিত হয়েছ। নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের বাংলাদেশের গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষা ঋতুর নির্ধারিত সীমানা মানছে না। শরতে-হেমন্তে, এমন কি, শীতের কয়েকটি দিনেও বৃষ্টিপাতের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শরতের নির্মল ছোঁয়া আর হেমন্তের মিষ্টি পরশ বলতে গেলে বিলীন। গরম আর বর্ষা দখল করেছে শরৎ আর হেমন্তকে। শীত অস্বাভাবিকত্ব দেখাচ্ছে। বসন্তের পেলবতাও চরম আবহাওয়ার কাছে লীন।
প্রাকৃতিক বিরূপতায় আমাদের জীবনচক্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। আবহাওয়ার শ্বাশত ধারা মনে হয় হারিয়ে গিয়ে নতুন একটি ঋতুগত কাঠামো আমাদেরকে আচ্ছন্ন করছে। জীবনের নান্দনিক প্রভায় ঋতুর বৈশিষ্ট্যকে উপভোগের দিন যেন অপসৃয়মান। প্রতিটি ঋতুতেই লেগেছে অদল-বদলের মাতাল হাওয়া। জীবনে ও সাহিত্যে চিরচেনা ঋতুগত কালগুলোকে আর আদি ও অকৃত্রিমভাবে নিটোল আকারে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত, সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বিশেষত কবিতায় লেখা শীত বা অন্যান্য ঋতুর চিত্রকল্প মনে হয়, ইতিহাসের অংশ হয়ে জীবনের বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে যাচ্ছে। তার বদলে আসছে অন্য রকম শীত, অন্য রকম বর্ষা বা গ্রীষ্ম। ঘোরতর পরিবর্তমান প্রকৃতির আওতায় মানুষ অসহায় এখন। মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণ তথা বৃক্ষ ও সবুজ নিধক এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ বিরোধী আচরণের ফল কড়ায় গণ্ডায় শোধ করছে হচ্ছে এখন খোদ মানুষকেই।