মানহীন পণ্যের ভিড়ে আসল পণ্য চেনা দায়
দেশজুড়ে মানহীন পণ্যের ভিড়ে আসল পণ্য পাওয়াটাই দিন দিন দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাজার, দোকান, সুপার শপ সব জায়গাতে ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য মিলানো কঠিন হয়ে উঠছে। মাছ, মাংস, দুধেও ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন কেমিক্যাল। ফলে সঠিক মানের শিশু খাদ্য মেলাও দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে মানহীন পণ্য বাজার দখল করতে চললেও নীরব দর্শকের ভূমিকায় আছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্ট্রিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)। এমন পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে ১৪ অক্টোবর (রোববার) পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মান দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে আর্ন্তজাতিক মান’।
জানা যায়, মাছ, মাংস, ফলে ফরমালিনের ব্যবহার কমলেও বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে এখনো। শাক-সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, ব্রেড, বিস্কুট, সেমাই, নুডলসসহ সব রকম মিষ্টিতে টেক্সটাইল-লেদারের রং। আর মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজেনের অবাধ ব্যবহার তো চলছেই। অতিরিক্ত রেডিয়েশনযুক্ত শিশুখাদ্য গুঁড়া দুধ আমদানি হচ্ছে দেদারসে। নোংরা পানি ব্যবহার করে আইসক্রিম বানানো হচ্ছে ময়লা-আবর্জনার স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে। খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোটা রীতিমতো অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।
চাল, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, আলু থেকে শুরু করে রুটি, কেক, মিষ্টি, বিস্কুট কিছুই ভেজালের ছোবল থেকে বাদ যাচ্ছে না। জীবনধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি পানি পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না।
যত্রতত্র নকল কারখানা বানিয়ে পুকুর-ডোবা ও ওয়াসার পানি সরাসরি গামছায় ছেঁকে বোতলজাত করা হচ্ছে। সে পানিতে থাকছে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম-লেড-ইকোলাই। এসব পানিই ‘বিশুদ্ধ মিনারেল পানি’ হিসেবে নামিদামি কোম্পানির সিলমোহরে সরবরাহ করা হচ্ছে।
কলা, আম, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস থেকে শুরু করে আপেল, আঙ্গুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও তা উজ্জ্বল বর্ণে রূপান্তরের জন্য অধিক ক্ষারজাতীয় টেক্সটাইল রং ব্যবহার হচ্ছে অবাধে।
বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, সীমিত তৎপরতা ও মাসোহারার দৌরাত্ম্যে জনস্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। মানসম্পন্ন পণ্য ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করাসহ ক্রেতাস্বার্থ রক্ষায় কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির অভাবে দেশ মানহীন, অবৈধ, নকল খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে সয়লাব হয়েছে। অনেকে আবার বিএসটিআইর লোগো ছাপিয়ে এসব মানহীন পণ্য বাজারজাত করছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এটা থেকে রেহাই মিলবে না।
তিনি বলেন, ‘বারবারই নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি বাজার মনিটরিংয়ের বিষয়ে বলে আসছিলাম। বাজারগুলোতে তদারকি ও সমিতির সাথে আলোচনা এবং সতর্ক করা হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের চেয়েও ভালো ফল পাওয়া যেতো। এখন মাঝে মাঝে অভিযান হয়, জরিমানা করা হয়। কার্যত কোনো সুফল আসছে না। এভাবে চলতে থাকলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে।’
সূত্র মতে, বিএসটিআই মান কোড সমর্থন করে- এমন পণ্যের বাজারজাতকরণের আগেই পণ্যের গুণগত মানের নিশ্চয়তা (পণ্য পরিক্ষা) বিএসটিআই সিএম সনদ গ্রহণ করতে হয়। সিএম সনদ ছাড়া পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাত করা যায় না।
পণ্যের মোড়কে সিএম সনদের নম্বরও উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু অনেক পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের সিএম সনদ না নিয়েই পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। পরীক্ষাবিহীন এসব পণ্যের গুণগত মান ঠিক রয়েছে কিনা, তা যাচাই করতে পারেন না ভোক্তারা। আবার বিএসটিআই মনোগ্রাম ব্যবহার করাতে সরল বিশ্বাসে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন।
বিএসটিআই চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক সাজ্জাতুল বারি বার্তা২৪কে বলেন, ‘ভেজাল থেকে বাচার জন্য ঐ ভেজাল পণ্য এড়িয়ে চলতে হবে। আসল এবং নকল পণ্য চিনে ব্যবহার করতে হবে। আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বিএসটিআইয়ের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ ভিজিলেন্স টিমের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।’
বিএসটিআই সূত্র মতে, বিএসটিআইয়ের মূল তদারকির কাজ চারটি বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিভাগগুলো হল- টেস্টিং কেমিক্যাল, টেস্টিং ফিজিক্যাল, মেট্রোলজি ও সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম)। কেমিক্যাল পরীক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত ১৯৪ টি পণ্যের মধ্যে চট্টগ্রামে সম্পূর্ণ করা যায় মাত্র ৫৯টি। বাকি পণ্যেগুলোর পরীক্ষার জন্য ঢাকার ওপর নির্ভর করতে হয়।
কেমিক্যাল টেস্টের বাইরে ২৫টি পণ্য রয়েছে টেস্টিং ফিজিক্যালের তালিকাভুক্ত। এই বিভাগের ২৫টি পণ্যের মধ্যে মাত্র নয়টি পণ্যের শতভাগ পরীক্ষা চট্টগ্রামে করা সম্ভব হচ্ছে। নতুন আঞ্চলিক ভবন হলে পূর্ণাঙ্গ ল্যাব সুবিধা পাবে বিএসটিআই। তখন তালিকাভুক্ত সকল পণ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। এতে করে পণ্যের মান সম্পর্কে সচেতনতা ও নিশ্চয়তা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।