রোকেয়ার সমাধিতে ফুল দিতে চায় রংপুরবাসী
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই পাকিস্তান থেকে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের মরদেহ চাঁপাইনবাবগঞ্জে আনা হয়। এরপর রংপুরের মানুষ রোকেয়ার মরদেহটিও পায়রাবন্দে এনে সমাহিত করার জোরালো দাবি জানায়। করে আন্দোলনও। ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মেলায় রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম এনামুল হক দাবিটির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে মরদেহ পায়রাবন্দে আনার প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপর থেকে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ, বেগম রোকেয়া ফোরাম, বেগম রোকেয়া পাঠাগারসহ বিভিন্ন সংগঠন এই দাবি বাস্তবায়নে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক স্মারকলিপি প্রদান করেছে। এ নিয়ে এখনো রংপুরে সভা, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠকসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে স্থানীয়রা। রোকেয়া অনুরাগীরা দাবিটি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলেও জানিয়েছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
২০১০ সালে রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম এনামুল হক বলেছিলেন, ‘মরদেহ পায়রাবন্দে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। আগামী বছর (২০১১) রোকেয়া দিবসের আগে তার মরদেহ পায়রাবন্দে আসবে বলেও তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ঘোষণার পর ছয় বছর চলে গেছে। কিন্তু আজও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন।
বেগম রোকেয়াকে নীতিনির্ধারক মহলে গুরুত্ব দেয়া হয় না বলে অভিযোগ করে পায়রাবন্দে অবস্থিত ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদ’। এখানকার স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিবিসি’র জরিপে বিশ্বসেরা ২০ নারীর তালিকায় ৬ নম্বর স্থান পাওয়া বেগম রোকেয়ার মরদেহ পূর্বের ডিসি সাহেব ঘোষণা দিয়েছিলেন পায়রাবন্দে আসবে। কিন্তু সেই ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত এখন ফাইলবন্দী। অথচ রোকেয়ার সমাধিতে ফুল দিতে চায় রংপুরবাসী।’
অন্যদিকে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, ‘২০০৯ সালে প্রশাসনের দেয়া প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। ভেবেছিলাম ২০১০ সাল থেকেই রোকেয়ার সমাধিতে আমরা ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে পারব। কিন্তু সেই আশায় বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। ঘোষণা বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই।’
একজন মহীয়সী নারীকে নিয়ে প্রশাসনের এ রকম প্রহসন উচিত হয়নি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হাততালি নেয়ার জন্য তৎকালীন ডিসি সাহেব ওই ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিষয়টি এখন স্পষ্ট।’
এদিকে রোকেয়ার ভাতিজি রনজিনা সাবের বলেন, ‘সরকারের কী এমন সমস্যা আছে যে আমাদের এই সামান্য দাবিটুকুও পূরণ করতে পারছে না। অন্যদের মরদেহ যদি আনা যায়, তবে কেন রোকেয়ার মরদেহ আনতে সরকার এতো টালবাহানা করছে। তা আমাদের বোধগম্য নয়।’
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য রংপুরের বর্তমান জেলা প্রশাসক (ডিসি) এনামুল হাবীবের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, আজ ৯ ডিসেম্বর নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৩৮তম জন্ম ও ৮৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। উপ-মহাদেশের নারীসমাজকে কু-সংস্কারের দেয়াল ছেদ করে আলোর মশাল হাতে ধরিয়ে দেয়া এই নারীর অনুরাগীদের মন ভালো নেই। সরকারের অবহেলা আর উদ্যোগহীনতার কারণে এখানে রোকেয়া চর্চা ও পর্যটন কেন্দ্রের দ্বার রুদ্ধ। ছয় বছর আগে জেলা প্রশাসনের দেয়া রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে আনার প্রতিশ্রুতিও লালফিতায় বন্দী।
বাংলা তথা উপমহাদেশের বন্দী নারীদের শেকল ছিঁড়ে স্বমহিমায় আলোকিত জীবন গড়ার প্রদীপ জ্বালানো রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দের নিভৃত পল্লী খোর্দ্দমুরাপুর গ্রামের বিখ্যাত সাবের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তারা বাবা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ও মা রাহাতুন্নেসা সাবের চৌধুরানী। ১৮ বছর বয়সে খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেন সাহেবের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ২৮ বছর বয়সে স্বামী হারান তিনি। ১৯১০ সালের শেষ দিকে কলকাতায় যান তিনি। এরপর তিনি দু’পারেই নারী জাগরণ ও উন্নয়নে কাজ করেছেন।
নারী জাগানিয়া চিন্তা থেকে লিখেছেন অবিরাম-অবিরত। সমাজের কুসংস্কার ভাঙতে করেছেন সময়ের সাহসী উচ্চারণ। তার লেখা অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অর্ধাঙ্গী, মতিচুর ছাড়াও অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থ সে সময় নারী জাগরণ আন্দোলনকে উজ্জীবিত করে। আজও তা আন্দোলিত করছে বিশ্ব নারী সভ্যতাকে।
মহীয়সী এই নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মারা যান। কলকাতার সোদপুরে তাকে সমাহিত করা হয়।
প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও দিনটিকে ঘিরে সকালে জেলা ও বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে রোকেয়া স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ, বাদ জোহার মিলাদ মাহফিল এবং বিকেলে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন নারী সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থাগুলো একই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।