নীরব ঘাতক শব্দদূষণ

  • মুজাহিদুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: প্রতীকী

ছবি: প্রতীকী

স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতা প্রতিনিয়তই হারিয়ে ফেলছে রাজধানীবাসী। সড়কে হর্ন বাজানোর তীব্র প্রতিযোগিতা চলছেই। মানুষের সহন ক্ষমতার দুই থেকে তিনগুণ শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে এখানে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও চলতে হচ্ছে অতিরিক্ত শব্দদূষণের মধ্য দিয়ে। ফলে, নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছে নগরবাসী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে যে সরকারি ও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে হর্ন বাজবে না। এভাবেই সচেতনতা শুরু হবে। এখনই শব্দের উচ্চ মাত্রা কমানো না গেলে এই নীরব ঘাতক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মক্ষম মানুষকেও ধীরে ধীরে বার্ধক্যে পরিণত করবে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা ০-২০ ডেসিবেল, মৃদু মাত্রা ২১-৪০ ডেসিবেল, মাঝারি/সহনীয় মাত্রা ৪১-৭০ ডেসিবেল, তীব্র মাত্রা ৭১-৯০ ডেসিবেল, অসহনীয় মাত্রা ৯১-১২০ ডেসিবেল।

পরিবেশ অধিদফতরের ‘শব্দ দূষণ’ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক কর্মসূচির এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে শব্দদূষণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ১৩-৪০ ডেসিবেল বেশি। সবচেয়ে নীরব এলাকায় ৫০, আর শিল্প এলাকায় সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ থাকার কথা। অথচ পল্টন, ফার্মগেট, শ্যামলী, মগবাজার, গাবতলী, মিরপুর, মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডসহ ৭০টি এলাকাতেই শব্দের মাত্রা ১২০ থেকে ১৩০ ডেসিবেলের বেশি।

ফলে, মাথা ধরা, শারীরিক অবসাদ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, শ্রবণ শক্তি হ্রাসসহ ৩০টিরও অধিক কঠিন রোগের সৃষ্টি হয়। এতে আক্রান্তের ঝুঁকির তালিকায় এগিয়ে থাকে শিশু, বৃদ্ধ, বিশেষ করে হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ফরিদ উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে জানান, অতিমাত্রায় শব্দ দূষণের ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস, উচ্চ রক্ত চাপ, হৃদযন্ত্রের কম্পন বৃদ্ধি, হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত, মাংসপেশির খিঁচুনি এমনকি শিশুদের বেড়ে ওঠাকেও বাধাগ্রস্ত করে। এর জন্য রাস্তায় গাড়িচালকদের বেপরোয়া, বেহিসেবি ও অহেতুক হর্ন বাজানোর প্রবণতাই দায়ী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. সফিউল্লাহ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমাদের প্রবণতা এমন হয়েছে যে, আমি যত বেশি হর্ন বাজাবো তত আমাকে রাস্তা খালি করে দেয়া হবে। এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজেকে আগে সচেতন হতে হবে, তারপর অন্যকে বলতে হবে। এ ঘোষণা সরকারকেই দিতে হবে। সরকারের যত কর্মকর্তা কর্মচারী আছে তাদের ব্যবহৃত কোনো গাড়িতে আর হর্ন বাজবে না। তখন আমরা অন্যদেরকেও বলতে পারব যে হর্ন বাজাবেন না। এভাবেই সচেতনতা শুরু হবে। চেষ্টা করলেই সম্ভব হবে, এটা কঠিন কিছু না।’

ঢাকা ট্রাফিক বিভাগ পশ্চিমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোর্শেদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘শব্দ দূষণের কারণে আমি নিজেই ভুক্তভোগী। আমরা হাইড্রলিক হর্ন অপসারণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। আইন দিয়ে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। প্রয়োজন সচেতনতার।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাফিয়া সুলতানা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমি উত্তরা থেকে ক্যাম্পাসে আসি। জ্যামের পাশাপাশি অতিরিক্ত শব্দের কারণে মাথাব্যাথা করে। ক্যাম্পাসে আসতে আসতেই অনেকটা সেন্সলেস অবস্থা। ক্লাসে মন বসে না, কিছুই ভালো লাগে না, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। অনেক সময়ে এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন কমন রুমে শুয়ে পড়ি।’

বিজয় সরণিতে কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জন চন্দন চক্রবর্তী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমরা যারা ট্রাফিকে কাজ করছি শব্দদূষণের ফলে আমাদের প্রতিনিয়ত শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। ডিউটি শেষে যখন বাসায় ফিরি তখন মনে হয় গাড়ির শব্দই শুনছি। বাসায় গিয়ে কখনো মনে হয় না শান্ত পরিবেশে আছি। আমাদের অনেকের কানে সমস্যা দেখা দিয়েছে। অসংখ্য রোগী পাচ্ছি যারা কানের চিকিৎসা নিচ্ছেন। সচেতনতা ছাড়া এটা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।’