‘আমাদের কথা বইয়ের পাতায় ঠাঁই পায় না’
ছোট্ট একটা দোকান। সেখানে স্তূপ করে রাখা বইয়ের পাতা। চল্লিশোর্ধ এক ব্যক্তি বসে সুই-সুতো দিয়ে বইয়ের পাতাগুলো একত্রিত করে বাঁধাই করছেন। বাঁধাই শেষে বইয়ের উপরিভাগে আঠা মেখে থিসিস কাভারে (মোড়ক) আবৃত করছেন। মাঝেমধ্যে দু’একজন উৎসুক পথচারী আগ্রহ নিয়ে ওই ব্যক্তির হাতের দিকে তাকিয়ে দেখছেন।
রোববার (২৪ মার্চ) রাত সাড়ে ৮টায় ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্র দূর্গাবাড়ি মোড় এলাকায় এমন দৃশ্য দেকা যায়।
কথা হয় বই বাঁধাকারী ওই ব্যক্তির সঙ্গে। তার নাম সাইফুল ইসলাম লিটন (৪৫)। বাবা আব্দুল গফুর এবং মা আয়েশা খাতুন। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে লিটন চতুর্থ। জীবিকার তাগিদে গত ২৯ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি।
বই বাঁধাই করতে করতেই বার্তা২৪.কমকে লিটন বলেন, ‘অভাবের কারণে তৃতীয় শ্রেণিতেই পড়াশোনার ইতি ঘটে। জীবিকার তাগিদে ১৯৮০ সালে ময়মনসিংহ শহরের একটি প্রেসে কাজ নিই। সেখানে কাশেম ভাইয়ের কাছ থেকে বই-খাতা বাঁধাই করারা কাজ শিখি। এরপর এই পেশায় কেটে গেছে ২৯ বছর। তবে এখন আর কাশেম ভাইয়ের সাথে থাকি না। কয়েক বছর আগে নিজেই দোকান দিয়েছি। বই, খাতা ও প্রকাশনা সামগ্রীকে সুন্দর ও মজবুত করার জন্য বাঁধাই করার প্রয়োজন হয়। মোটামুটি সব মৌসুমেই চলে বই-খাতা বাঁধানোর কাজ।’
তিনি জানান, ময়মনসিংহ ও আশে পাশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বিদ্যালয়সহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে বই-খাতা বাঁধানোর কাজ করেন। এছাড়া ছাপাখানা বা বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে কাজের অর্ডার পেয়ে থাকেন। বাঁধাইয়ের ক্ষেত্রে কাজ অনুযায়ী সর্বনিম্ন ২০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেন। রাজধানী ঢাকা শহর থেকে বাঁধাইয়ে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করে তা দিয়ে কাজ করেন।
দাম্পত্য জীবনে লিটনের স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। এরমধ্যে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তবে নিজে পড়াশোনা করতে না পারলেও ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চান লিটন।
লিটনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৯টার ঘরে। সড়কে কমেছে যানবাহন ও পথচারীর আনাগোনা। এমন সময় আগমন ঘটে প্রতিবেশী ব্যবসায়ী আরিফ আহামেদের। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘লিটন ভাই খুব যত্ন করে ভালভাবে বই-খাতা বাঁধাই করেন। আশেপাশে অনেক দোকান থাকলেও লিটন ভাইয়ের কাজ গুণগত মান অনেক ভাল।’
কথার রেশ টেনে লিটন বলেন, ‘ভাল বই-খাতা বাঁধাই করলে কি হবে? আমাদের মতো খেঁটে খাওয়া মানুষের কথা বইয়ের পাতায় ঠাঁই পায় না? বই নাকি আলোকিত মানুষ তৈরি করে। কিন্তু আলোকিত মানুষরা বই-বাঁধাইয়ের পেছনে থাকা অন্ধকারের মানুষদের দুঃখ দুর্দশার খবর রাখে না।’