ইতিহাসের ভয়াল কালরাত্রি আজ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। রাতের নিকষ কালো আঁধারে, ঘুমন্ত বাঙালি জাতির উপর ‘অপরাশেন সার্চলাইটের; নামে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছিল দখলদার পাকিস্তানি বাহনী। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগমুহূর্তে বিভীষিকাময় ওই কালরাতে নৃশংসতম গণহত্যার নজির স্থাপিত হয়েছিল। সেই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের বড় বড় শহরে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে লাখো ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে। বাঙালি জাতি যত দিন আছে, ততদিন প্রতিবছর ফিরে আসবে ২৫ মার্চের কাল রাত। এই রাতে গোটা জাতি গভীর শ্রদ্ধা আর অবনতমস্তকে স্মরণ করবে সেই মানুষদের, যারা একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে পাকিস্তানিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন।
যা ঘটেছিল সেই রাতে:
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ বুধবার ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে চলমান মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান সরকারের উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকও কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বৈঠক শেষে সেদিন বিকালেই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ নেতা পিআইএর একটি ফ্লাইটে ঢাকা ছেড়ে যান। কিন্তু আলোচনার নামে ধূর্ত পাকিস্তানিরা আসলে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিল। সেটা অনেকে টেরও পেয়েছিলেন। কেননা একদিকে যখন চলচিল আলোচনা, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্লাটুন প্লাটুন সৈন্য এসে নামছিল ঢাকার মাটিতে।
২৫ মার্চের সকাল থেকেই অজানা আশঙ্কায় দিন কেটেছে বাঙালির। দিনভর দেশব্যাপী ছিল অশান্ত-উত্তাল পরিস্থিতি। এমনি এক পরিস্থিতিতে এক সময় বেতারের প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারি কোনো ঘোষণাও প্রচারিত হয়নি সেদিন। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত অবধি মিছিল-মিটিং-স্লোগানে মুখরিত ঢাকাবাসী রাত নামলে ঘুমিয়ে পড়ে। আর গভীর রাতে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষদের উপর সার্চলাইট অপারেশন শুরু করে নর পিশাচরা।
রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রথমে রাস্তায় নেমে আসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারা প্রথমে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পরে একে একে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমণ্ডি ও পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তানি রাইফেলস (ইপিআর- বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরসহ রাজধানীর সর্বত্র হামলা চালিয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাশাপাশি নিধনযজ্ঞ চালায় চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরেও।
রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতরে পাকিস্তানি সেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণে রাজি হননি। রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তারা। তবে শত্রুর ট্যাঙ্ক, কামান আর ভারী মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে গুঁড়িয়ে যায় সমস্ত প্রতিরোধ বূ্হ্য। জ্বালানি ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশ সদর দফতর। সেখান থেকে ঘাতক বাহিনী এগোতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে। পরে রাতভর গোটা রাজধানীতেই নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা।
মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকসহ স্বাধীনতার দাবিতে বাঙালির বিক্ষোভে উত্তাল জনপদের খবর সংগ্রহ করতে তখন ঢাকায় আসা বিদেশি সাংবাদিকরা অবস্থান করছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এ হোটেলের ১২ তলায় দেহরক্ষীদের কড়া পাহারায় ঘুমাচ্ছিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। রাত পৌনে ১২টায় পাকিস্তানি সেনারা হোটেলটি ঘিরে ফেলে। কেউ বেরুলেই গুলির নির্দেশ দেয়। এভাবেই বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় ঢাকাকে। এর পরপরই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে নগরজুড়ে ভেসে আসতে শুরু করে পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাঙ্ক, মেশিনগানের গুলি ও মর্টারের শব্দ। সেই শব্দে কান পাতা দায়।
ভারী ট্যাঙ্ক ও সৈন্যবোঝাই লরিগুলো নল উঁচিয়ে ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। একে একে ইকবাল হল, (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) জগন্নাথ হলসহ সব হলেই হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। এর মধ্যে জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে রক্ষা পাননি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। এক রাতে তিন শতাধিক ছাত্রছাত্রী শহীদ হন। শাহাদাত বরণ করেন ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষক।
পুরান ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও চালানো হয় ব্যাপক গণহত্যা। কয়েকটি পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি নগরজুড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর রাতভর চলে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ ও ধ্বংসের তাণ্ডব। দানবীয় বাহিনীর আক্রমণের বিভীষিকায় নিমজ্জিত হয় নগরীর রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাত, খেলার মাঠ ও ক্যাম্পাস। মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। মর্মন্তুদ সে কান্না ছাপিয়ে চারপাশে তখন কেবলই আগুনের লেলিহান শিখা ও ধ্বংসযজ্ঞ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ হয়েছে লাশের স্তূপ। এক সময় গোটা নগরীই পরিণত হয় লাশের শহরে।
এক মিনিট প্রতীকী ‘ব্লাকআউট’:
২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে 'জাতীয় গণহত্যা দিবস' হিসেবে পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এর পর থেকেই দিনটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। সেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সরকারসহ বিভিন্ন মহলের সর্বাত্মক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। কালরাত্রিকে স্মরণ করে সোমবার (২৫ মার্চ) রাতে এক মিনিট অন্ধকারে থাকবে পুরো বাংলাদেশ। ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ পালনে বিভিন্ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাত ৯টা থেকে ৯টা ১মিনিট পর্যন্ত চলবে এই প্রতীকী ‘ব্ল্যাকআউট’ কর্মসূচি। জরুরি স্থাপনা ও চলমান যানবাহন ছাড়া সারাদেশে এই এক মিনিট ব্লাকআউট চলবে।
এছাড়া কালরাত্রি স্মরণে সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তনে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, তথ্যচিত্র প্রদর্শন এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। রাত ৯টার পর জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে গণসমাধিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও শ্রদ্ধা নিবেদন হবে। বাদ জোহর দেশব্যাপী মসজিদগুলোতে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়গুলোতে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। ঢাকাসহ সকল জেলা ও উপজেলায় করা হয় আলোচনা সভা, গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন।