পাসপোর্ট অফিসে জাল সত্যায়ন, ফরম পূরণ চক্রের দৌরাত্ম্য
ছবি ও কাগজপত্রের জাল সত্যায়ন দিয়েই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা দিচ্ছেন অনেকেই। এসব আবেদনের সত্যায়ন যাচাই-বাছাই ছাড়াই জমা নিচ্ছেন কর্মকর্তারা।
গত মঙ্গলবার (১৮ জুন) কেরানীগঞ্জে অবস্থিত যাত্রাবাড়ী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের ঠিক উল্টো পাশে গড়ে উঠেছে কিছু ফটোকপি ও চা-নাস্তার দোকান। এসব ফটোকপির দোকানে দাম হেঁকে হেঁকে সত্যায়িত করা হচ্ছে। ছবি আর জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে এনে এখান থেকেই কেউ কেউ পূরণ করছেন আবেদন ফরম।
পাসপোর্টের আবেদন ফরম পূরণ করা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, এখানে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় আবেদন ফরম সত্যায়িত করা হয়। পুরো আবেদন ফরম পূরণ করলে সেই খরচ ভিন্ন। আবেদন ফরম পূরণ করে পাস করিয়ে দেওয়ার অজুহাতেও টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন চক্রের সদস্যরা।
সত্যায়িত কয়েকটি ফরম অনুসন্ধান করে জানা যায়, ফরমের সঙ্গে যুক্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সত্যায়িত হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের নামে। কিছু সত্যায়ন হচ্ছে সরকারি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক ও অধ্যাপকের নামে।
পেশায় প্যাথলজিস্ট এক নারী; থাকেন রাজধানীর বনশ্রীতে, পাসপোর্টের আবেদন করতে এসে তিনদিন যাত্রাবাড়ী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে ফিরে গেছেন। বিভিন্ন ছুতোয় তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বার্তা২৪.কমকে ওই নারী বলেনি, আমি আগে যতবার এসেছি আমাকে এটা নাই, সেটা নাই করে ফিরিয়ে দিয়েছেন গেটে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা। একদিন এইটা নাই তো আরেক দিন ওইটা নাই বলে, কিন্তু পুরোপুরি বলে না। আজ বলছে সত্যায়িত করতে হবে। নিরুপায় হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর এক আনসার সদস্য বলল— ৮০০ টাকা দেন সত্যায়িত করিয়ে দিচ্ছি। পরে বুঝলাম এখানেও সত্যায়িত করা যায়। এরপর রাস্তার ওপারের দোকানে গিয়ে সত্যায়িত করতে চাইলে তারা ৫০০ টাকা চাইল। তাদের কাছেই সত্যায়িত করলাম, ফরমও জমা দিয়ে দিলাম।
তবে জমা দেওয়ার আগে নজর পড়ে আবেদন ফরমটিতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মীজানুর রহমান নামে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের সিলে সত্যায়িত দেখা যায়।
এদিকে সম্পূর্ণ আবেদন ফরম পূরণ করার চুক্তি করেছেন বিথী আক্তার নামে দোহার থেকে আসা এক নারী। তিনি কত টাকা দিয়েছেন জানাতে রাজি না হলেও আবেদন ফরমটি পূরণ হয়েছে বলে দেখালেন। তার কাগজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এমবিবিএস ডাক্তার উত্তম দেবের সিল বসিয়ে সত্যায়িত করেছেন জালিয়াত চক্রের সদস্যরা।
জাল সিল দিয়ে সত্যায়ন করা চক্রের সদস্যরা নিজেদের নাম-পরিচয় গোপন করে বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা মানুষকে সেবা দিয়ে টাকা নেই। একজন মানুষ বিপদে পড়েছেন, ভুল করে কিছু ফেলে এসেছেন। তাতে কী? মূল ভোটার আইডি থাকলে বাকি দায়িত্ব আমাদের।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এদের সঙ্গে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের আনসার সদস্যদের ভালো সখ্যতা রয়েছে। দৈনিক হারে টাকা ঢুকে তাদের পকেটে। কিছু কর্মকর্তাও এসব কাজের সঙ্গে জড়িত। জাল সত্যায়িত আবেদন নিয়ে কেউ ঝামেলায় পড়লে তাদের সমাধানের জন্য আছেন অফিসের ইন্সপেকশন অফিসার হূমায়ুন কবির রিফাত। তিনি সরাসরি নিয়ে যান উপ-পরিচালকের কাছে। তাহলেই আবেদন ফরমটি আটকানোর কেউ আর থাকে না।
প্রধান ফটকে দায়িত্বরত আনসার সদস্য আলমগীর বলেন, আমরা মানুষকে হয়রানি করি না। কেউ অসম্পূর্ণ আবেদন নিয়ে আসলে তাকে ফিরিয়ে দেই।
জাল সত্যায়ন করা চক্রের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে রেগে যান ইন্সপেকশন অফিসার রিফাত। তিনি বলেন, এসব আমি জানি না। আপনাদের যা কথা আছে স্যারের সঙ্গে বলবেন। বড় স্যার ছুটিতে আছেন, রোববার এসে কথা বলবেন।
উপ-পরিচালক ছুটিতে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে উপ সহকারী পরিচালক হেলাল উদ্দিন বলেন, কে কী করেন এটা আমার জানার কথা না। আমরা তো সত্যায়ন ভেরিফাই করতে পারি না। আবেদনের সব প্রয়োজনীয় অংশ পূরণ দেখলে আমরা আবেদন ফরম জমা নেই।