নদী বাঁচানোর সুপারিশ যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে
রাজধানী ঢাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত তুরাগ নদসহ দেশের সব নদ-নদী ও উন্মুক্ত জলাধার অবৈধ দখল ও দূষণমুক্ত করতে সরকারের নানান পদক্ষেপ থাকলেও তার বাস্তবায়ন নগণ্য। বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের দেওয়া এ সংক্রান্ত আদেশ ও নির্দেশনারও অবমূল্যায়ন হচ্ছে।
তাই নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা বিবেচনা করে সম্প্রতি উচ্চ আদালত যে রায় ও সুপারিশমালা দিয়েছেন তার পূর্ণাঙ্গ কপি এবার পাঠানো হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।
ঢাকার চতুর্দিকে চক্রাকার চারটি নদ-নদী তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু ও শীতলক্ষ্যা প্রতিনিয়ত দূষণ ও অবৈধ দখলের শিকার। বিশেষ করে দূষণ, দখল আর পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করে নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের কারণে তুরাগ নদটি মৃতপ্রায়। পরিবেশবাদী সংগঠন ও ব্যক্তিদের বিভিন্ন সময়ে করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত বার বার সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নানা আদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সব নদ-নদী ও উন্মুক্ত জলাধারকে দূষণ ও দখলমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, রাজধানী ঢাকার চারদিকে বেদখল হওয়া নদ-নদী যে অবৈধ দখলমুক্ত হচ্ছে না সেটি পুরোপুরি ঠিক নয়। আমরা বিভিন্ন সময় মামলা করেছি। নদীগুলো দখলমুক্ত হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ হতে কিছুটা সময় লাগবে।
আরো অন্তত দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে। সরকারও এ ব্যাপারে আন্তরিক। প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) সম্প্রতি কয়েকটি নদীর উন্নয়নে ৯০০ কোটি টাকার বাজেট বাড়িয়ে ২২০০ কোটি টাকা করেছে। এটি ইতিবাচক দিক।
উচ্চ আদালত ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু ও শীতলক্ষ্যাসহ অন্যান্য উন্মুক্ত জলভাগ রক্ষায় নৌ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনসহ ঢাকা, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু একদিক দিয়ে উচ্ছেদ হয় আবার অন্যদিক দিয়ে দখল হয়ে যায়।
বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষণমুক্ত করতে ও এর নাব্যতা বাড়াতে ২০১৬ সালের নভেম্বরে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ২ হাজার কোটি টাকার এক বাজেট ঘোষণা করেন। এ বাজেট ঘোষণাকালে খোকন বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বুড়িগঙ্গার দৃশ্যও হাতিরঝিলের মতো বদলে যাবে। তবে আড়াই বছর পার হয়ে গেলও লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি বুড়িগঙ্গায়।
নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে অবিহিত করে ১ জুলাই ২৮৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন উচ্চ আদালত। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। গত ৩ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হয়। এ রায়ের মধ্য দিয়ে তুরাগ নদকে লিগ্যাল ও জ্যুরিসটিক পারসন বিবেচনা করে রায়ে আরো বলা হয় দেশের সকল নন-নদী এ মর্যাদা পাবে। মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ রায় দেন।
এ বিষয়ে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, নদী জীবন্ত সত্তা সংক্রান্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গ যে কপি প্রকাশ হয়েছে তাতে উল্লেখ আছে যে, এর কপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। আদালত সম্প্রতি যে নির্দেশনা দিয়েছেন তার মধ্যে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ১৭ দফা নির্দেশনা রয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান যারা থাকেন তাদের আইন প্রণয়ন করতে হয়। আইন প্রণয়নের সময় যেন আদালতের সুপারিশগুলো থাকে সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে কবে পূর্ণাঙ্গ কপিটি পাঠানো হবে সে ব্যাপারে তিনি বলেন, সবেমাত্র রায় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।
নদ-নদী ও উন্মুক্ত জলাশয়কে জীবন্ত সত্তা ঘোষণার বিষয়ে আইনজীবী মোরশেদ বলেন, প্রবাহকে সচল রাখতে প্রতিটি নদ-নদী আইনি অধিকার পেতে পারে, যেমনটি পায় মানুষ ও প্রাণী। নদী তো আর মামলা করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি, সংগঠন বা সংস্থা পিটিশন করবে নদীর পক্ষে। যেমন কোনো কোম্পানি যখন পিটিশন করে তখন ওই কোম্পানি পিটিশনার। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামলা পরিচালনা করে থাকেন। নদ-নদী ও উন্মুক্ত জলাধারের ক্ষেত্রেও এমনটি প্রযোজ্য হবে। যেমন কোনো পিটিশনার বুড়িগঙ্গার পক্ষে পিটিশন করতে পারবেন। নদীটির কোথায় কী হানি হচ্ছে অর্থাৎ তার জীবন রক্ষা হচ্ছে না—এভাবে বুড়িগঙ্গার পক্ষে যে কেউ পিটিশন করে প্রতিকার চাইতে পারবেন।
এর আগে চলতি বছর জানুয়ারি মাসে নদ-নদী ও উন্মুক্ত জলাধার বাঁচাতে এসব জলরাশিকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তোলেন জলাধার নিয়ে কাজ করা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংগঠনের গবেষক এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি দুই দিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ দাবি উত্থাপন করা হয়। সেখানে বক্তারা বলেন, নদ-নদীর অধিকার রক্ষায় এবং এসব জলরাশিকে তাদের মতো থাকতে দিয়ে তাদের অনুভূতিকে আমলে নিয়ে তাদের সত্তার স্বীকৃতি দিতে হবে।