এবারও লোকসানের আশঙ্কা, হতাশায় পাট চাষিরা
মেহেরপুর: গেল দুই বছর ধরে পাটের দরপতনে হতাশায় ভুগছে মেহেরপুরের পাট চাষিরা। সাম্প্রতিক সময়ে পাটের দর কিছুটা বেড়েছে। তবে পাটের বাজার দর নির্ধারণ না থাকায় লোকসানের আশঙ্কা পিছু ছাড়ছে না চাষি ও ব্যবসায়ীদের। ফলে চলতি মৌসুমে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
এদিকে জেলার পাট চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে প্রায় দুই লাখ মণ পাট অবিক্রিত রয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গেল বছর জেলার তিনটি উপজেলায় ২৫ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়। চলতি মৌসুমে প্রায় ত্রিশ হাজার হেক্টর জমিতে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কৃষি বিভাগ। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কারণ চলতি মৌসুমে মাত্র ২০ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়।
সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের চাষি জাহিদুজ্জামান জানান, গত বছর দেড় বিঘা জমিতে পাট আবাদ করে তার লোকসান হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। তাই চলতি মৌসুমে পাট আবাদ করেননি। প্রতি মণ বিক্রি হয়েছিল এক হাজার থেকে ১২শ টাকা পর্যন্ত। দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মণ হলে লাভ হবে বলেও জানান তিনি।
মুজিবনগর উপজেলার রসিকপুর গ্রামের আকবর আলী জানান, প্রায় প্রতি বছরই তিনি কম বেশি পাট আবাদ করেছেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে পাট আবাদে সাহস পাননি। গেল কয়েক বছরের অব্যাহত লোকসানে পড়ে পাট চাষিদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তা পুষিয়ে নিতে ধানসহ অন্যান্য আবাদের দিকেই ঝুঁকছেন।
গাংনী উপজেলার পূর্ব মালসাদহ গ্রামের চাষি মোক্তার হোসেন বলেন, ‘আমি ১০ কাঠা জমিতে পাট আবাদ করেছি। পাটে লোকসান হতে পারে। পাটকাঠি পরিবারের অনেক কাজে লাগে। চাষি পরিবারে পাটের চেয়ে পাটকাঠির কদর বেশি।’
স্থানীরা জানায়, গত দুই বছর ধানের দরে বেশ সন্তুষ্ট চাষিরা। তাছাড়া সবজি ও ভুট্টা চাষেও চাষিরা লাভবান হচ্ছে। তাই পাট আবাদ খ্যাত মেহেরপুর জেলার চাষিরা পাটের বিকল্প চাষের দিকেই নজর দিচ্ছে। ব্যয় ও অতিপরিশ্রম করেই পাট আবাদ সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু অতি সহজেই ধান ও কিছু সবজি আবাদ করা সম্ভব। তবে জ্বালানি, বেড়া ও ঘরের ছাউনিসহ পরিবারের নানা কাজের জন্য পাটকাঠির ব্যবহার অপরিহার্য। এ কারণে স্বল্প পরিসরে কিছু কিছু চাষি পাট আবাদ করেছে।
মেহেরপুর জেলার বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী গাংনীর হাজী আলফাজ উদ্দীন জানান, বিদেশে কাঁচা পাট রপ্তানি না থাকায় পাট বিক্রি হচ্ছে না। বিজেএমসি সঠিক সময়ে পাট কেনার টাকাও পরিশোধ করতে পারছে না। অপরদিকে অর্থাভাবে পাট কিনছে না রপ্তানিকারকরা। যার ফলে চাষি ও ব্যবসায়ীদের গুদামে হাজার হাজার মণ পাট অবিক্রীত পড়ে রয়েছে। এতে প্রতিদিনই বাড়ছে লোকসানের পরিমাণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পাটের দর এক হাজার ২শ টাকা থেকে ১ হাজার ৬শ টাকায় উঠেছে। এ দরে বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা লোকসান থেকে বাঁচবে।
জানা গেছে, সোনালী আঁশ খ্যাত পাট এখন মেহেরপুরের চাষি ও ব্যবসায়ীদের গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দুই লক্ষাধিক মণ পাট এখন চাষি ও ব্যবসায়ীদের গুদামে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। বাজারে ক্রেতা না থাকায় পাট বিক্রি করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা।
এদিকে পাট মন্ত্রণালয়ের সবশেষ নির্দেশ অনুযায়ী ১৭টি কৃষি পণ্য ২০ কেজি বা এর বেশি ওজনের ব্যাগে বহন করতে হলে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে সরকার। কিন্তু এসব পণ্যের মধ্যে বাজারে চাল ও আলু ছাড়া অন্যান্য পণ্যে কমেনি প্লাস্টিক বস্তার ব্যবহার। নেই মনিটরিং বা ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের কোনো প্রতিফলন। আটা ময়দা চিনি ডালসহ বেশির ভাগ ব্যবহৃত পণ্যেই দেদারসে ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিক বস্তা। একই অবস্থা আমদানি করা চাল, ডাল, রসুন ও আদার বস্তায়। এতে পাটপণ্যের চাহিদা কমেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পাট বাজারে।
গেল বছরে দেশে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৮ হেক্টর জমিতে ১৫ লাখ ১১ হাজার ২২১ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়েছে। আর মেহেরপুর জেলায় পাট উৎপাদন হয়েছে ৭৭ হাজার ৫৩৫ মেট্রিক টন।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. আখতারুজ্জামান জানান, আসলে চাষিরা যেদিকে লাভ পাবেন সেই ফসলই আবাদ করবেন। পাটের লোকসান পোষাতে চাষিদেরকে আউস ধান আবাদের পরামর্শ দেওয়া হয়। চলতি মৌসুমে আউস ধানের আবাদও বৃদ্ধি পেয়েছে।