ঘুষ ছাড়া হয় না জমি রেজিস্ট্রি!
পাবনা: জমি রেজিস্ট্রি করতে সরকারি ফির চেয়ে বেশি টাকা দিতে হয় ক্রেতাদের। কারণ নির্ধারিত ফিতে রেজিস্ট্রি করতে না চাইলেই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন তারা। আর এই হয়রানি করে থাকেন রেজিস্ট্রার, সাব-রেজিস্ট্রাররা। ফলে জমি রেজিস্ট্রির নামে অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা।
জেলা ও উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তা শুধু পাবনাতেই নয়, সারা বাংলাদেশ জুড়ে সবখানেই ঘটছে। এমন দাবি করেছেন পাবনা জেলা-রেজিস্ট্রার মনিন্দ্র নাথ বর্মণ।
অভিযোগ উঠেছে, জেলার ৯টি উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে প্রতিদিন ১০ লক্ষাধিক টাকার ঘুষ বাণিজ্য হচ্ছে। আর এই ঘুষ বাণিজ্যের সিংহভাগ টাকাই জেলা-রেজিস্ট্রার, সাব-রেজিস্ট্রার, অফিসের বড় বাবু (হেড ক্লার্ক) ও দলিল লেখক সমিতির সদস্যদের পকেটে যাচ্ছে।
পাবনা জেলার ৯ উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে প্রতিদিন গড়ে ১০ লক্ষাধিক টাকার ঘুষ বাণিজ্য হচ্ছে এমন দাবি দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত কার্যালয় পাবনার উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের। তিনি বলেন, ‘জমি রেজিস্ট্রি কর্মকাণ্ডে অনিময়, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে কয়েকজন দুর্নীতিবাজ সাব-রেজিস্ট্রারকে মৌখিকভাবে সর্তক করে দেয়া হয়েছে। তবুও তাদের এ সকল অনিয়মতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না। খুব শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ভাবে অভিযানে নামবে দুদক।’
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পৌরসভা এলাকাতে একটি দলিল সম্পাদনে সরকারি ভাবে গড়ে ১৪ শতাংশ এবং পৌর এলাকার বাইরে গড়ে ১১ শতাংশ ফি দিতে হয়। এর বাইরে দলিল লেখক সমিতিকে এককালীন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা, সাব-রেজিস্ট্রারকে দলিলের ৫ শতাংশ, অফিস বড় বাবু এবং দালাল চক্রকে আরও অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয় জমির ক্রেতা সাধারণকে।
সূত্রটি বলছে, এর বাইরেও সরকারি দলসহ স্থানীয় প্রভাবশালী এবং চাঁদাবাজ চক্রকে চাঁদা দিতে হয়। দলিল লেখকরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সমিতির নামে যে টাকা আদায় করছে সে বিষয়টি নিয়েও কাজ করছে দুদক।
জানা যায়, পাবনার আটঘরিয়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার ইশরাত জাহান (২৮) ও মোহরার আশরাফুল আলম (৪০) গত ১০ জুলাই দুদকের পাতা জালে হাতেনাতে গ্রেফতার হন। ওই উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ৪টি দলিল নিষ্পত্তি করে দেয়ার শর্তে দলিল লেখকের মাধ্যমে মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহণ করেন অভিযুক্তরা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই দিন বিকেলে দুদকের একটি টিম অভিযান চালিয়ে ঘুষের ১৪ হাজার টাকাসহ সাব-রেজিস্ট্রার ইশরাত জাহান ও মোহরার আশরাফুল আলমকে ৪৮ হাজার টাকাসহ আটক করেন।
দুদক সমন্বিত কার্যালয় পাবনার উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক জানান, দীর্ঘদিন ধরেই জমির খাজনা-খারিজ করে দেয়ার নামে সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত টাকা নিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে আসছিলেন আটঘরিয়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার ইশরাত জাহান ও মোহরার আশরাফুল আলম।
এ ব্যাপারে কয়েকজন দলিল লেখকের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, ‘আমরা দলিল লেখক। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমরা কাজ করে থাকি। কিন্তু কোনো দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করতে গেলে পদেপদে আমাদের টাকা দিতে হয় ক্রেতাদের কাছ থেকে নিয়ে। অতিরিক্ত টাকা লাগে এটা ক্রেতা সাধারণও ভালোভাবেই জানেন। সাব রেজিস্ট্রারকে উৎকোচ না দিলে সহজে দলিল রেজিস্ট্রি হয় না। শুরু হয় নানা ভুল ধরাসহ বিভিন্ন সমস্যার ফাঁদ। একদিকে আমরা আর অন্যদিকে ক্রেতারা নিরুপায় হয়েই অতিরিক্ত টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রির কাজ করে থাকি।’
দলিল লেখকদের অভিযোগ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যদি অতিরিক্ত টাকা দাবি না করেন তাহলে তাদের দলিল লেখায় অতিরিক্ত টাকার দরকার নেই। রেজিস্ট্রার, সাব-রেজিস্ট্রারদের উৎকোচ গ্রহণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চান দলিল লেখকরা।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাবনা সদর সাব-রেজিস্ট্রার ইব্রাহিম হোসেন জানান, আটঘরিয়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার ইশরাত জাহানকে সাজানো নাটকের মাধ্যমে আটক করা হয়েছিল। আর দুদকের এই আটকের ঘটনায় সারা দেশের সাব-রেজিস্ট্রাররা ক্ষুব্ধ।