শোকের মাসের শুরু: কাঁদো, বাঙালি কাঁদো
শুরু হলো শোকের মাস আগস্ট। বাঙালি জাতির জীবনের এক শোকাবহ মাস আগস্ট। এ মাসের ১৫ তারিখ এ জাতি হারিয়েছে তার মহত্তম সন্তানকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘাতকের নির্মম আঘাতে সপরিবারে নিহত হন ধানমন্ডির বাড়িতে। বিশ্বের ইতিহাসের আগস্ট চিহ্নিত শোকে, বেদনায়, অশ্রুতে।
এই আগস্টে বাংলাদেশে ঝরছে শ্রাবণের অবিশ্রান্ত ধারা। এ যেন বাঙালির ক্রন্দনকাল। মানবতার জন্য, জাতির জনকের জন্য যেন কাঁদছে মানুষ এবং প্রকৃতি।
১৫ আগস্ট যখন কিছু বর্বর খুন করেছিল বাঙালির সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ পুরুষ ও স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তখন মানবতা ও মনুষ্যত্ব নিহত হয়েছিল। তাঁর হত্যাকাণ্ড আজো জাতি হিসেবে আমাদের অপরাধী করে দেয়। আমরা বার বার বিবেকের সামনে মুখোমুখি হয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই কলংকিত এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে।
জাতির পিতাকে হত্যা করায় জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হয়। ভূলুণ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত চেতনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল ইতিহাসের কলঙ্কিত খলনায়কেরা, তা ছিল সুদূরপ্রসারী যড়যন্ত্রের অংশ। বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়াই ছিল সেই যড়যন্ত্রের নীল নকশা। কারণ, পঁচাত্তরের পর কেন এই দেশের উন্নয়ন হতে দেরি হয়েছে, কেন এই জাতি হতে পারে নি ঐক্যবদ্ধ, সেটাতো লুকিয়ে রয়েছে সেই পিতৃ হত্যার মধ্যেই ।
বাংলাদেশের মত সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হতে সময় লাগার কারণ এ রাষ্ট্রের জন্মের মাত্র ১০ বছরের মধ্যে দেশের সবচেয়ে ত্যাগী, মেধাবী ও পরিশ্রমী নেতা-কর্মী-নীতিনির্ধারকদের হত্যা করা হয়েছে। এই আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ দেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও নির্মমভাবে স্বপরিবারে খুন করে প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদীদের এদেশীয় দোসররা। এই হত্যার রাজনীতি আর থেমে থাকেনি। তা চলেছে এবং একের পর এক এ রাষ্ট্রের একেকটি স্তম্ভকে ভেঙে দিয়েছে।
এসব কিছুই হতোনা যদি না ১৯৭৫ সালের সেই কালরাত্রিটা না আসতো। বঙ্গবন্ধুর মত জাতীয়তাবোধসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক ক্ষমতায় থাকলে এদেশের ব্যাপারে কাছের বা দূরের কোন শক্তি খবরদারি করার সাহস পেতোনা। সে কারণে তাঁর মৃত্যুর পর সকল পক্ষই চুপ করে ছিল। সে কারণে সেই খুনী কুলাঙ্গাররা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রদূত থেকে জাতিসংঘে পর্যন্ত চাকরি করেছে। সে কালো ইতিহাস আজ সবারই জানা।
শোকের মাস হলেও রক্তাক্ত আগস্ট শিক্ষা দেয়, বিপথগামী-যড়যন্ত্রকারীরা যখন নিজ জাতির মূল নেতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন জাতি কয়েক শ বছর পিছিয়ে যায়। যে নেতার মোহন নেতৃত্বে সহস্র বছর পর বাঙালির জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটালো স্বাধীনতার মহান সূযোদয়ের মাধ্যমে, তা পাশবিক শক্তির কবল থেকে রক্ষার শিক্ষাও দেয় আগস্ট।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শত্রু ছিল তৎকালীন একটি কুচক্রী মহল। গণবিরোধী এই চক্র জাতির পিতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাপুরুষের মতো হত্যা করে। এক পক্ষ নৈরাজ্য তৈরি করে হত্যার মঞ্চ প্রস্তুত করে, আরেকপক্ষ বর্বরভাবে হত্যাকান্ড সংঘটিত করে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পৈচাশিক উল্লাস করেছিল খুনিচক্র এবং বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী বাঙালির ভাগ্যের উপর দীর্ঘদিনের জন্য কালিমা এঁকে দিয়েছিল। যে কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসম্পদ থাকার পরেও আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারিনি। অমানবিক ও অবৈধ ক্ষমতা দখল, সেনা শাসন ও জঙ্গি নির্মমতা গণতন্ত্রকে গ্রাস করেছিল।
গণতন্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করার এই পশুসুলভ আচরণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সব সময় ছিলেন সোচ্চার। তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১৯৫ পাতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছে, তাতেই আমাদের ভয় হলো। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুলি করে হত্যা করা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি তারা এই সমস্ত জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি।’
সেই নির্মম আঘাতই নেমে এলো বঙ্গবন্ধুর জীবনে। কারণ, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন অনুৎপাদনশীল সকল খাত ও সংস্থাকে উৎপাদনশীল করতে, গরীব-দুঃখীর জন্য কাজ করাতে, ছাত্রদের গ্রামে পাঠিয়ে কাজ করাতে, কৃষককে দেশের সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিকে পরিণত করতে। এ কারণেই সুবিধা ও ভোগবাদীরা তাঁর বিরোধিতা করে।
সিআইএ, মোসাদ, আইএসআই এর ম্যান্ডেট নিয়ে এসে মানুষের নেতাকে হত্যা করতে যারা পেরেছিল এই আগস্টের কোন এক ভোররাতে তাদের প্রতি খোদার অভিশাপ পড়বে। তারা এই দুনিয়ায় হয়েছে অপদস্থ, অপমানিত ও তাদের নাম নেয়ার মত কেউ নেই এবং মৃত্যুর পরের দুনিয়ায়ও এই জালিমদের কঠিন শাস্তি হবে স্রষ্টার কাছে এই প্রার্থনা করি। আগস্ট মাসে নিহত সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। কামনা করি, আগস্টের শোক হোক জাতির ঐক্য ও অগ্রগতি শক্তি এবং গণতন্ত্র, অবৈধ ক্ষমতা দখল, মানবতা বিরোধী সকল অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শাণিত চেতনা।