নষ্ট হচ্ছে চামড়া, বিপাকে ব্যবসায়ীরা
কোরবানির মৌসুমে অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় ২০ শতাংশ কাঁচা চামড়া। এ বছরও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে অনেক চামড়া। ব্যবসায়ীরা বলছেন ট্যানারি কর্তৃপক্ষের অবেহেলায় আর খরিদদারদের অব্যবস্থাপনায় চমড়াগুলো নষ্ট হচ্ছে। আর ট্যানারি কর্তৃপক্ষ বলছে, চামড়া নষ্টের জন্য ব্যবসায়ীদের অপরিপক্কতাই দায়ী।
শনিবার (২৫ আগস্ট) লালবাগের পোস্তা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চামড়ার গুদামগুলোর সামনে সারি সারি পঁচা চামড়া পড়ে আছে। কিছু কিছু ক্রেতাও সেসব চামড়া কিনতে আসছেন, তবে মূল দামের ১০ শতাংশ দামও বলছেন না খুচরা ক্রেতারা। অনেক ব্যবসায়ী এসব চামড়া ফেলার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাড়তি দামে তারা চামড়া কিনেছেন। কম দামে বিক্রি করে যেন লোকসান গুণতে না হয় তাই এসব খুচরা ব্যবসায়ীদের অনেকেই প্রথম দুই দিন চামড়া বিক্রি করেননি। তাদের প্রত্যাশা ছিল শেষ দিকে এসে পাইকারি বাজারে চামড়ার দাম বাড়বে। কিন্তু চামড়ার দাম তো বাড়েইনি উল্টো কমেছে অনেক। যারা চামড়া ধরে রেখেছিলেন তাদের চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। এ বছর প্রায় ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।
কাজী শাজাহান অ্যান্ড সন্সের প্রোপাইটার মো: কাজী সোহেল বার্তা২৪.কমকে বলেন, কোম্পানী আমাদের চামড়াগুলো দরদাম ঠিক করার পর, পরে লেবার সংকটের কথা বলে আর নেয়নি। ফলে আমাদের প্রায় তিনশ' চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। যেই চামড়া আমাদের ৮০০ টাকা বলে গেছে ক্রেতারা, তা এখন একশ' টাকায়ও বিক্রি করতে পারব না। এছাড়াও ট্যানারিতে চামড়া বিক্রির জন্য দাম ঠিক করে দিয়ে আসার পর এখন বলছে নির্ধারিত দামের চেয়েও অনেক কম দেবে। এখন এই চামড়া তো আমরা ফেরতও আনতে পারব না। এবার চামড়ায় কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
কাজী অপু চামড়া গুাদামের কর্মচারি মো: আনসার বার্তা২৪.কমকে জানান, আমাদের প্রায় ১২শ' চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। ট্যানারি মালিকরা বলে তাদের কাছে টাকা নেই, বাকিতে নিতে চায়। আবার যেগুলোও তাদের দিয়েছি, পরে তারা চামড়ার দাম নির্ধারিত দামের চাইতেও কম দিতে চাইছে। এখন এগুলো আমরা কিভাবে ফেরত আনব। আমরা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। নষ্ট চামড়াগুলোর জন্য আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন দাম তো পাবই না, উল্টো এগুলো ফেলার জন্য টাকা দিতে হবে।
এদিকে পোস্তা বাজার থেকে পচে যাওয়া চামড়া আবর্জনা হিসেবে নিয়ে যেতে গেছে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। বিনষ্ট হওয়া এসব চামড়ার মূল্য লাখ টাকার বেশি বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
চামড়া নষ্ট হওয়া বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি হাজী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, লবন ঠিকমতো না দিলে চামড়া নষ্ট হবে। আমরা ব্যবসায়ীদের বলেছি চামড়া কেনার ছয় থেকে আট ঘন্টার মধ্যে বিক্রি করে ফেলতে। নতুবা লবণ দিয়ে দিতে। আপনি বিক্রি করলেন না, লবণও দিলেন না। ফলে চামড়াটা নষ্ট হয়ে গেল। তার মানে তারা রাষ্ট্রের ক্ষতি করলেন, যে রাষ্ট্রর ক্ষতি করল তাকে তো পুলিশে দেয়া উচিত।
চামড়ার দাম ঠিক করেও অনেকে নেয়নি এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, টাকা সবচেয়ে বড় সমস্যা। টাকা ছিল না তাই আনেকে চামড়া কিনতে পারেনি। দেখা গেছে, আমি দাম বলেছি দুই ঘণ্টার পর টাকা শেষে হয়ে গেছে। তাই তারা চামড়া নিতে পারিনি। এটা হতে পারে। কিন্তু আমরা তো অনেককে সহযোগীতা করেছি। আমরা ঘরের লবণ দিয়ে চামড়ায় লবণ দিয়েছি। বলেছি বিক্রি করে পরে লবনের টাকা দিয়ে দিতে। কিন্তু লোকের অভাবে অনেক জায়গায় লবণ মাখা যায়নি।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে একটি ট্যানারির সুপারভাইজার নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, আমরা সঠিকভাবেই চামড়া কিনেছি। দাম নির্ধারণ করে, পরে কম দেয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ আমরা তাদের দাম নির্ধারণ করেই তো চামড়া রাখি, তাহলে কম কেন দেবো। আর চামড়া নষ্টের জন্য দায়টা তাদেরই। কারণ সঠিকভাবে লবণ দিয়ে রাখলে চামড়া তো নষ্ট হওয়ার কথা না।
লেদার ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড টেকনোলজি সোসাইটি, বাংলাদেশের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোরবানির মৌসুমে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচা চামড়া অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে প্রাণিসম্পদ খাতে দেশ প্রতি বছর ৩৬৫ কোটি টাকার ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চামড়ার পরিবহনে রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। সঠিক সময়ে পরিমাণমতো লবণ দেয়ায় রয়েছে কার্পণ্যভাব ও উদাসীনতা। এছাড়া সঠিক তাপমাত্রায় লবণজাত চামড়ার রক্ষণাবেক্ষণেও থাকে নানা ঘাটতি। এসব কারণে কোরবানির মৌসুমে সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ চামড়া নানাভাবে তার গুণাগুণ হারাচ্ছে। ফলে প্রক্রিয়াজাত পর্যায়ে তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনও দেশে চামড়া সংগ্রহের বিভিন্ন স্তরে দারুণভাবে অবহেলা লক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে প্রতি বছর কোরবানির মৌসুমে পাওয়া চামড়ার ১৮ থেকে ২০ শতাংশই অকেজো হয়ে পড়ছে।