‘মাথিনের কূপ’ অসমাপ্ত প্রেমের অমর নিদর্শন
প্রায় একশ বছর আগে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। কলকাতার সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য্য অতি ভয়ংকর ও দুর্গম জনপদ টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন। যদিও থানায় তার তেমন কোনো কাজ ছিল না। অনেকটা এখানে সেখানে ঘুরেই সময় কাটাতেন। থাকতেন থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষে।
একদিন ভোরে একাধিক নারীকণ্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভেঙে যায়। থানার ছোট বারান্দায় এসে দেখেন রঙ-বেরঙের ফতুয়া (থামি-ব্লাউজ) পরিহিত ৫০-৬০ জন রাখাইন তরুণী পাত কুয়ার (কুয়া) চারদিকে জড়ো হয়ে হাসি গল্পে মশগুল। তাদের সুউচ্চ কলহাস্যে থানা প্রাঙ্গণ মুখরিত। এটিই ছিল সমগ্র টেকনাফের একটি মাত্র কুয়া।
প্রতিদিন তরুণীরা পাত কুয়ায় জল নিতে আসতেন। আর ধীরাজ থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে তরুণীদের জল তোলার দৃশ্য দেখতেন। একদিন ধীরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত আরেক তরুণীকে। সুন্দরী এই তরুণীর নাক,চোখ, মুখ বাঙালি মেয়েদের মতো। টেকনাফের জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র মেয়ে, যার নাম মাথিন। প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে তার ভালো লেগে যায়। এরপর থেকে প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই ধীরাজ ভট্টাচার্য্য থানার বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসতেন এবং মাথিনের আগমনের প্রতীক্ষা করতেন।
মাথিন যখন কলসি কাঁখে তার সুউচ্চ গ্রীবা দুলিয়ে থানা প্রাঙ্গণ দিয়ে হেঁটে আসতেন ধীরাজ তন্ময় হয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করতেন। অন্যান্য তরুণীরা আসার আগেই মাথিন পাত কুয়ায় আসতেন এবং জল নিয়ে ফিরতেন। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে তারা একে অপরের সঙ্গে গভীর প্রেমে আচ্ছন্ন হতে থাকেন। ঘনীভূত হতে থাকে তাদের প্রেম। একদিন, দু’দিন, এভাবে দিন গড়াতে থাকে। ইতোমধ্যে দু’জনের প্রেমের কথা সবাই জেনে যায়। নানা বাধা সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়।
এরই মাঝে ধীরাজের কাছে কলকাতা থেকে তার বাবার চিঠি আসে। ধীরাজকে কলকাতা যেতে হবে এক মাসের ছুটি নিয়ে। ছুটি না মিললে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। ধীরাজ সিদ্ধান্ত নেন কলকাতায় যাবেন। সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানানো হয়। তবে মাথিন রাজি হলেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ধীরাজ এক সন্ধ্যায় টেকনাফ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।
ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। মাথিনের মনে হল, বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ধীরাজ তাকে বিয়ে করার ভয়ে পালিয়েছে। প্রাণ পুরুষ ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্যজল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী। জমিদার বাবা ওয়ানথিনসহ পরিবারের সদস্যরা শত চেষ্টা করেও মাথিনকে অন্নজল ছোঁয়াতে পারেননি। তার এক কথা- ধীরাজকে চাই। প্রেমের এই বিচ্ছেদ এবং অতি কষ্টে একদিন মাথিন মারা যান। এ কারণে পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য্য ও রাখাইন তরুণী মাথিনের ভালোবাসা আর ট্র্যাজেডির ঐতিহাসিক প্রেমের সাক্ষী ‘মাথিনের কূপ’ দেখে এখনো হাজারো প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের অমর প্রেমের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়।
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। প্রতিবছর ভালোবাসা দিবসে, ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন এই মাথিনের কূপ দেখতে টেকনাফ থানায় ভিড় জমান দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা অসংখ্য দর্শনার্থী। মাথিনের কূপের সামনে দেয়ালে লেখা, তাদের অমর প্রেমের গল্প পড়ে মুগ্ধ হন এসব দর্শনার্থীরা। আবার অনেকেই বিয়োগান্তক এ ভালোবাসার গল্প পড়ে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন।
উল্লেখ্য, কলকাতার সুদর্শন যুবক পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ও রাখাইন তরুণী মাথিনের ভালোবাসা ও ট্র্যাজেডির অমর প্রেমগাঁথা স্মৃতি নিয়ে ১৯৩৫ সালে পাকিস্তানের লাহোরের ইউনিক পাবলিকেশন থেকে ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। যা ধীরাজ ভট্টাচার্য্যের আত্মজীবনী নিয়ে লেখা।