একই নামে মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার দু’জন, বিপাকে প্রশাসন
নাম ঠিকানা একই হওয়ায় একই গেজেটে লালমনিরহাট ও রংপুরের দুইজন নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করছেন। এরা হলেন- লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের কাজিরচওড়া গ্রামের মৃত তারিনী চন্দ্রের ছেলে ও মসলা বিক্রেতা প্রতাপ চন্দ্র রায় এবং রংপুরের গংগাচওড়া ইউনিয়নের উত্তর ধামুর গ্রামের তারিনী কান্তের ছেলে প্রতাপ চন্দ্র রায়। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তে বিপাকে প্রশাসন।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি মসলা বিক্রেতা প্রতাপ চন্দ্রকে নিয়ে বার্তা২৪.কম-এ ‘ভোট আসলে সবাই কথা দেয়: ভাতা বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধা’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এরই মধ্যে সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবু বক্কর সিদ্দিক ভাতা প্রদান না করতে উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘এই গেজেটে রংপুর সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের আওতায় ৩২৯ নং বইয়ের বিপরীতে একই নামে একজন ২০১৪ সাল থেকে ভাতাভুক্ত রয়েছেন।’
পরবর্তীতে উপজেলা প্রশাসনের আহ্বানে রংপুরের ভাতাভোগী শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র রায় কাগজপত্রসহ হাজির হন। তবে সাক্ষাতকারে যুদ্ধের ঘটনার বর্ণনা, দাখিলকৃত কাগজপত্র ও ঠিকানার যথেষ্ট গরমিল পায় প্রশাসন। সাক্ষাতকারে তিনি জানান, যুদ্ধের সময় কিছুদিন এই এলাকায় থাকায় ঠিকানা লালমনিরহাটের কাজিরচওড়া লিখেছেন। কিন্তু এ সময় তিনি কাজিরচওড়া গ্রামের কোথায় ছিলেন তা জানাতে পারেননি।
শুধু তাই নয়, সনদে তার ঠিকানা রংপুর শহরের রাধাবল্লব বলা হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে রয়েছে রংপুরের গংগাচওড়া উপজেলার উত্তর ধামুর। ভাতা নিচ্ছেন রংপুর সদর উপজেলা সমাজসেবা থেকে। এছাড়া লালমনিরহাটের কাজিরচওড়া গ্রামের প্রতাপ চন্দ্র রায় হিসেবে লাল মুক্তিবার্তার ৩১৪০১০৪৩৬ নং ক্রমিক ব্যবহার করলেও সনদের ঠিকানা রংপুরের রাধাবল্লব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধার সনদ (নং ৩১০০৮) অনলাইনে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার এমএ খালেক নামে একজন মুক্তিযোদ্ধার তথ্য আছে। যে সনদটি দিয়ে দীর্ঘ ৪ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানি ও চাকরিতে বিশেষ কোটার সুবিধা ভোগ করে আসছেন তিনি।
রংপুরের গংগাচওড়া উত্তর ধামুর গ্রামের স্থানীয়রা জানান, শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্রের বাবার নাম তারিনী কান্ত রায়। যুদ্ধের সময় তিনি নিজ গ্রামেই ছিলেন এবং গংগাচওড়া হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। পরবর্তীতে রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
তবে শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘১৯৯৯ সালে লালমনিরহাটের একজন মুক্তিযোদ্ধার সহায়তায় আমি আবেদন করি। ২০০০ সালে যাচাই বাচাই শেষে আমাকে সনদ দেওয়া হয়। আর ২০১৪ সালে ভাতাভুক্ত হই।’
তবে সনদে অনলাইনে অন্যজনের তথ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সনদ প্রদানকারীরা প্রতারণা করেছেন। সমস্যা হলে ভাতা উত্তোলন করব না।’
এ সময় এই প্রতিবেদককে তিনি নিউজ প্রকাশ না করতে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের লাল মুক্তিবার্তার ৩১৪০১০৪৩৬ নং ক্রমিক এবং ২০০৫ সালের ৩০ মে প্রকাশিত বেসামরিক গেজেটের ৫১৪৫ নং পৃষ্ঠার ৪৯৭ নম্বরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রয়েছেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের কাজিরচওড়া গ্রামের মৃত তারিনী চন্দ্রের ছেলে প্রতাপ চন্দ্র রায়। তিনি লালমনিরহাট মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ৩৩৪ নং ভোটার। তিনিও সম্মানি ভাতার জন্য কয়েক বছর ধরে সংসদ কমান্ড নেতা ও সরকারি বিভিন্ন দফতরে ঘুরছেন।
মসলা বিক্রেতা প্রতাপ চন্দ্র রায় বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘সম্মানির জন্য নয়, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। মৃত্যুর আগে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখে যেতে চাই।’
লালমনিরহাটের হারাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কাজিরচওড়া গ্রামে মৃত তারিনী চন্দ্র রায়ের ছেলে প্রতাপ চন্দ্র রায় নামে একজন ব্যক্তিই আছেন। যিনি গ্রামে ঘুরে গরম মসলা বিক্রি করেন।’
লালমনিরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়শ্রী রানী রায় বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘একই নামে দু'জনই নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে পুনর্বাসন এবং ভুয়াকে শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে সনদ, ঠিকানা ও যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনায় শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র রায়ের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।