বিউটি বোর্ডিং আছে, বিউটিয়ানরা নেই!
পুরান ঢাকার শ্রীশ দাস লেনের হলুদ রঙের দোতলা ১ নম্বর বাড়িটি। এই বাড়িটিতে ৫০-৬০ দশকে জমে উঠত কবি সাহিত্যিক লেখকদের আড্ডার পশরা; চলত শিল্প ও সাহিত্যের চর্চাও। রাজনীতিক চর্চাও কম হত না।
সেখানে যেমন বঙ্গবন্ধু আসতেন তেমনি আসতেন কবি সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান আর বেলাল চৌধুরীরা।
এখন সেই দিন আর নেই; নেই অতীত সেই ঐতিহ্যও। অভিজাতরাও তেমন আসে না; হয় না সেই সাহিত্য ও শিল্প চর্চা আর রাজনীতি নিয়ে গরম গরম কথার জমজমাট আড্ডা।
বাড়িটি ‘বিউটি বোর্ডিং’ নামে পরিচিত হলেও আসলে এটি আবাসিক হোটেল। যার গোরা পত্তন ১৯৪৯ সালে। এর আগে এটি ছিল পুরানো জমিদারবাড়ি, দেশ বিভাগের জমিদার পরিবারটি চলে গেলে ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হত। পরে আবার হাতবদলে তা কিনে নেন বিক্রমপুরের (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) প্রহ্লাদ সাহা। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আবাসিক হোটেল বিউটি বোর্ডিং।
বিউটি বোর্ডিং এ আসতেন কবি শহীদ কাদরী। কাদরীর পদচারণায় বেড়ে যায় কবি-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গের আনাগোনা। বেড়ে যায় শিল্প ও সাহিত্যের চর্চাও। কবি সাহিত্যিকরা ছুটে আসার আরেকটি কারণও ছিল। মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের কারণে।
অনেক কবি-সাহিত্যিকেরই লেখা তৈরির বহু ইতিহাস রয়েছে এই বিউটি বোর্ডিংয়ে। বেলাল চৌধুরী তার ‘সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় ভেসে’ বইয়ে বেশ কয়েক জায়গায় বিউটি বোর্ডিং সম্পর্কে লিখেছেন। সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে বলতে গিয়ে আসাদ চৌধুরী বলেছেন, ‘বেশ মনে পড়ে বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিং এ তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়।’
শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘মনে পড়ে একদা যেতাম প্রত্যহ দুবেলা বাংলা বাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই বিউটি বোর্ডিংয়ে পরস্পর মুখ দেখার আশায় আমরা ক'জন।’
বুলবুল চৌধুরী তার আত্মজীবনী মূলক বই ‘অতলের কথকতা’তে তার এক বন্ধু কায়েস আহমেদ সম্পর্কে লিখেছেন ‘কায়েস আহমেদই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বিউটি বোর্ডিং এ জড়ো হওয়া কয়েকজন তরুণ সাহিত্যিকের সামনে। বিউটি বোর্ডিং এ সমবেত হতে পারার মাধ্যমে দেশের অনেক নবীন প্রবীণ সাহিত্যিকের কাছাকাছি হতে পেরেছিলাম।’
এছাড়াও তৎকালীন সময়ে এখানে যাদের আড্ডার পশরা বসত, তাদের নামে একটা তালিকাও টানানো হয় আছে ভবনের দেয়ালে। কিন্তু তবে আগের সেই আড্ডার পশরা নেই। হারিয়ে যাচ্ছে সেই জৌলুস। এখন আসেন না সেই বিউটি বোর্ডিং বিউটিয়ানরা। বর্তমানে শুধু অতীত ঐতিহ্য কথা শুনে ছুটে আসে তরুণরা।
বিউটি বোর্ডিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রহ্লাদ সাহা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর পরিচালনার দায়িত্ব ভার পড়ে তাঁর দুই ছেলে সমর সাহা আর তারক সাহার উপর।
ছোট ছেলে তারক সাহা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘অতীতের টানে নতুন প্রজন্ম এখানে আসে। যেহেতু এখন থেকে এত বড় বড় লেখক সাহিত্যিক বের হয়েছে; সেজন্য আসে। তবে ওই সময়কার মতো আর তেমন কেউ আসে না।’
তরুণ কবি সাহিত্যিকদের প্রতি সৃষ্টিশীল লেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান, আগে যেমন সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড হত; তারাও যদি এরকম সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতিচর্চা করে তাদের জন্য দরজা খোলা থাকবে।’