ভাষা ও ধর্ম

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অমর একুশ, ছবি: বার্তা২৪.কম

অমর একুশ, ছবি: বার্তা২৪.কম

ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা একই সূত্রে গ্রন্থিত। কারণ, সমাজ, বিজ্ঞান ও ধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন বা চর্চার মাধ্যম হলো ভাষা। বিভিন্ন ধর্মে জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অতএব জ্ঞানার্জনের ধারায় ধর্মীয় দিক থেকেও ভাষার প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও বক্তব্য পাওয়া যায় মাতৃভাষার বিষয়েও।

ইসলাম ধর্মানুযায়ী, আল্লাহতায়ালা হজরত আদম আলাইহিস সালামকে জ্ঞান শিক্ষাদানের আগে ভাষা শিখিয়েছেন৷ ভাষা ছাড়া জ্ঞান শিক্ষাদান বা অর্জন অত্যন্ত কঠিন। ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম বলেই জ্ঞান ও শিক্ষার সূচনায় দেখা গেছে ভাষাকে।

বিজ্ঞাপন

পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাবপ্রকাশের উপযোগী ভাষা।’ -সূরা আর রহমান: ৩-৪

ভাষার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা হজরত আদমকে (আ.) একে একে সবকিছুর শিক্ষা দেন এবং এ শিক্ষার মাধ্যমেই তিনি নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। ফলে ধর্ম ও জাগতিক, উভয়ক্ষেত্রেই ভাষার হলো- শিক্ষার প্রথম মাধ্যম।

বিজ্ঞাপন

ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক বিবরণে দেখা যায়, তারপর আল্লাহতায়ালার ইচ্ছায় জ্ঞানের পরীক্ষায় নবী আদম ফেরেশতাদেরকেও হার মানাতে সক্ষম হন। এভাবেই মানুষ সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বা আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়। এ মর্যাদার মূল ভিত্তি হলো জ্ঞান। আর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হলো- ভাষা, যার গুরুত্ব অপরিসীম।

আল্লাহ হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করে তাকে ভাষা শিক্ষা দেন এবং সেই ভাষার মাধ্যমে তাকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করেন। এরপর জ্ঞানের দ্বারা হজরত আদম (আ.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব তিনি প্রমাণ করেন। এটা মহান স্রষ্টার এক সীমাহীন মহিমা ও অপরিসীম কুদরত বৈ আর কিছুই নয়। এ কুদরত প্রদর্শনের জন্যই তিনি আকাশমণ্ডলী বা সৌরজগৎ ও বৈচিত্র্যময় সুন্দর পৃথিবী, বিভিন্ন বর্ণে-গোত্রে বিভক্ত মানুষ ও ভাষার সৃষ্টি করেছেন। ভাষার পার্থক্য ও জাতিগত পার্থক্য সম্পর্কেও বলা হয়েছে যে, এটা করা হয়েছে, যাতে একে অপরকে চিনতে পারে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা আরও ঘোষণা করেন, ‘এবং তার (আল্লাহর) নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ -সূরা রূম: ২২

এই বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী, বিভিন্ন বর্ণ-গোত্র ও ভাষার বৈচিত্র্য সবই আল্লাহতায়ালার অসীম কুদরত ও নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বজগতে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে যেমন নানা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়, মানবজাতির মধ্যেও তেমনি বিদ্যমান রয়েছে নানা বর্ণ-গোত্র ও ভাষার মাধ্যমে সৃষ্ট চমৎকার বৈচিত্র্য। এসব বৈচিত্র্যের মাধ্যমে মহান স্রষ্টার অসীম কুদরত ও ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এটাকে যথারূপে উপলব্ধি করার মাধ্যমেই স্রষ্টার মহানত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব। এই আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃযোগাযোগের ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনের প্রতি উৎসাহিত দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যম হলো ভাষা।

পবিত্র কোরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ -সূরা ইবরাহিম: ৪

অর্থাৎ প্রত্যেক রাসূল ও নবীকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠানো হয়েছে এবং তার মাতৃভাষাতেই আল্লাহতায়ালা ওহি বা ঐশী আদেশ প্রেরণ করেছেন। অতএব, এর দ্বারা প্রত্যেক মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা ফুটে উঠেছে। অতএব মাতৃভাষার ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি না করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। নিজের ভাষার মর্যাদা দেওয়া ও চর্চা করার গুরুত্বও এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট হয়। ফলে নিজের মুখের ভাষাকে উপেক্ষা বা অবহেলা করা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। ধর্ম কখনোই তা বলে না। বরং ধর্ম মানুষে প্রজ্ঞাবান ও জ্ঞানী হওয়ার জন্য ভাষার পথ ধরে এগিয়ে চলার প্রেরণা দেয়।

এ কথা সহজেই বোধগম্য যে, মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে বা উপেক্ষা করে কোনো মানুষ বা জাতি কখনও উন্নতি লাভ করতে পারে না। মাতৃভাষার গুরুত্ব জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রসারিত। ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন কাজ সম্পাদনে এর প্রয়োজন অসীম। জীবনপথের প্রতিটি শাখাতেই মাতৃভাষার মুখাপেক্ষী প্রতিটি মানুষ। পরিবারে বা সমাজে সুন্দর ও সফল জীবনযাপন করার জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই।

জীবনকে জ্ঞান ও আলোয় পরিপূর্ণ করতে হলে প্রথমেই মাতৃভাষার দক্ষতা প্রয়োজন। পরবর্তীতে অপরাপর ভাষার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেটা মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে নয়। মাতৃভাষার প্রতি ইসলামের সমর্থন বাংলা ভাষা চর্চায় আত্মনিয়োগের তাগিদ দেয়।