ফেসবুক-টুইটারের যুগে বাংলা ভাষা
এ যুগ ফেসবুক, টুইটারের। যার অন্য নাম তথ্য প্রযুক্তির বিশ্ববিপ্লব। বলা হয়, এটাই বিশ্বায়নের আসল চেহারা।
যোগাযোগের বিশ্বায়ন শুধু যে পুরো পৃথিবীকে কাছে নিয়ে এসেছে, তা-ই নয়। বিশ্বায়ন তথ্য-প্রযুক্তির বৈপ্লবিক বিকাশের পথে সমগ্র জগতকে নিবিড়ভাবে কাছে নিয়ে এসেছে। দেশ-মহাদেশকে অদৃশ্য তথ্য প্রবাহের বিদ্যুতে সংযুক্ত করেছে।
এমন প্রবল স্রোতে কান পাতলেই এখন বিশ্বায়নের হাওয়ায় হাওয়ায় বাংলা ভাষার রক্তাস্নাত স্বর আর ব্যাঞ্জণ বর্ণগুলোতে গুঞ্জরিত হতে শোনা যায়। ফেসবুক, টুইটার, গুগুলের দেয়ালে অম্লান ফুটে আছে আ মরি বাংলা ভাষা।
কে না জানে যে, সমকালীন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক আর টুইটারও হয়ে উঠছে দ্রুততম উপায়ে স্বদেশ অথবা বিদেশের বহু দূর-দূরান্তের সুহৃদ মহলের সঙ্গে সামাজিকভাবে আলাপচারিতার এক নির্ভরযোগ্য সংযোগ মাধ্যম। যারা পঞ্চাশ, ষাট অথবা সত্তরের দশকে স্বপ্নের প্রবাস জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়ে বিদেশবাসী হয়েছিলেন, তাদের পক্ষে একবিংশ শতকের এই উন্নত টেকনোলজির মাধ্যমে স্বদেশের সঙ্গে, নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে, মাতৃভাষার সঙ্গে যোগাযোগ সংরক্ষণ সম্ভবপর ছিল না বলেই সন্তান সন্ততিদের নিয়ে নিজেরাও বিদেশি সংস্কৃতি এবং বিদেশি ভাষাকে গ্রহণ করতে তৎপর হয়েছিলেন। আজ প্রযুক্তি সংকট কাটিয়ে দিয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তি এখন বৈশ্বিক বাঙালিকে দিচ্ছে শেকড়ের সন্ধান।
ভাষা, সংস্কৃতি, গান, বাজনা, তথ্য, উপাত্ত, ইতিহাস, ঐতিহ্য সুদূর প্রবাসের একাকী ও নিঃসঙ্গ বাঙালিকে বিরূপ পরিবেশেও সমৃদ্ধ করছে। বিশ্বায়ন আর তথ্য-প্রযুক্তি একদিকে যেমন সুযোগ বাড়িয়েছে। অন্যদিকে কিছু ভাবনার বিষয়ও সামনে নিয়ে এসেছে।
কারণ, বিদ্যমান সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্যেও সৃজনশীল ভাবনার দরকার আছে। ইন্টারনেট আসার আগেও এমনটি অনেকেই ভেবেছেন। যেমন, ইন্টারনেট অথবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই কোনো কোনো বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ডিপার্টমেন্ট অফ দ্য ল্যাঙ্গুয়েজেস এন্ড কালচারস অব সাউথ এশিয়া ফ্যাকাল্টি’তে সংস্কৃত, উর্দু, তামিল, পাঞ্জাবি প্রভৃতি দক্ষিণ এশীয় ভাষাগুলোর পাশাপাশি বাংলা ভাষায় শিক্ষালাভের ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল এবং এখনও সেটা রয়েছে ক্রমবর্ধিষ্ণু হারে। বিদেশের এলিমেন্টারি ক্লাসগুলোর সিলেবাসে বাংলা বর্ণমালা, বাংলা শব্দ তালিকার বেসিক শব্দাবলি আর অতি প্রয়োজনীয় ব্যাকরণ বিষয়ক কোর্স সংযুক্ত করা হয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে। যারা ইন্টারমিডিয়েট অথবা আরো অ্যাডভান্সড ডিগ্রি অর্জন করতে উৎসুক, তাদের সিলেবাস কমপ্লিট করার জন্য রয়েছে উনিশ ও কুড়ি শতকের বাংলা ক্লাসিক সাহিত্যের সঙ্গে সমসাময়িক বিষয়ের ওপরে বিভিন্ন গবেষণামূলক কোর্স। ক্লাসিক সাহিত্য রচয়িতাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যরা হলেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, তারাশংকর, শরৎচন্দ্রসহ স্বল্প পরিচিত কিন্তু উন্নতমানের কিছুসংখ্যক কবিসাহিত্যিকরা।
ইউরোপ, আমেরিকার আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাংলা ভাষা শিক্ষালাভে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের যে সীমিত সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি সেসব প্রতিষ্ঠানে লক্ষ্য করা যায়, দুঃখের কথা হলো, তাদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অবাঙালি। প্রবাসী বাঙালির দ্বিতীয় কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে পূর্বপুরুষদের ভাষার প্রতি অতীত কিংবা বর্তমানে সেভাবে কখনই সশ্রদ্ধ ঔৎসুক্য অথবা আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়নি, এমন নয়। তবে যে হারে সেটা হওয়া উচিত ছিল, সেটা হয় নি। ইন্টারনেট ও সাইবার জগতেও প্রবাসী প্রজন্ম ভাষা-সংস্কৃতির জন্য জোর কদমে এগিয়ে আসছে না। বরং ঢাকা, কলকাতা থেকেই বাংলাকে নিয়ে কিছু কিছু কাজ হচ্ছে ভার্চুয়াল লাইফে।
সাইবার স্পেসের বাইরে তাকালে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকার যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ডিপার্টমেন্ট অফ দ্য ল্যাঙ্গুয়েজেস এন্ড কালচারস অফ সাউথ এশিয়া ফ্যাকাল্টি’ রয়েছে, তারা বিশ্বখ্যাত। যেমন, ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো, ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ উইসকন্সিন (যুক্তরাষ্ট্র)। ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ভ্যাংকুভার (কানাডা)। ইউনিভার্সিট অফ লন্ডন, ইউনিভার্সিটি অফ কেম্ব্রিজ, ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ড, স্কুল অব আফ্রিকান অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ-সোয়াস (যুক্তরাজ্য)। জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়াতেও ক্রমবর্ধমান হারে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সেন্টার হচ্ছে। কোথাও কোথাও বাংলাদেশ স্টাডিজ চালু হওয়ার কথাও জানা যাচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে বাঙালির চেয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী বের হচ্ছে বেশি।
ফলে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, নৃতত্ত্ব, ভাষা, সংস্কৃতিসহ সমুদয় বিষয়ই চর্চা ও গবেষণা হওয়ার সুযোগ ঘটেছে, যা স্বল্প সংখ্যক বিদেশি কাজে লাগালেও প্রবাসী বাঙালি প্রজন্ম পুরোপুরি গ্রহণ করছে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবাসীর অংশগ্রহণ আসলেই আশাব্যাঞ্জক নয়।
পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন বিদেশি ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও সংস্থার মাধ্যমে তথ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থার নানাবিধ সুযোগ সাইবার জগতে বাংলা সংক্রান্ত তথ্যের বিশাল ভাণ্ডার সাজিয়ে দিচ্ছে। এতো কিছু হলেও সেখানে প্রবাসী বাংলা ভাষীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে বাড়ছে না।
বাংলা ভাষীদের অংশগ্রহণ ও সংযুক্তি না বাড়লে বিশ্বায়নের বিরাট বড় দুনিয়ায় বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কে? বিশ্বের মোট বাঙালির যে ২০-৩০% ভাগ সদস্য প্রবাসে জীবন-যাপন করেন, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে তারা নিশ্চুপ ও নিস্পৃহ হলে তা কেবল বেদনাবহই নয়, চরম দুঃখজনকও বটে।