সমুদ্রের বালুচরে অবকাশের মারমেইড জীবন

  • মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মারমেইড বিচ রিসোর্ট/ছবি: বার্তা২৪.কম

মারমেইড বিচ রিসোর্ট/ছবি: বার্তা২৪.কম

মারমেইড বিচ রিসোর্ট (কক্সবাজার) থেকে ফিরে: সকালে জানালা গলে চোখ মেললেই বিস্তৃত বালুচর। কাঠের বারান্দায় এসে পড়েছে ভোরের রক্তিম সূর্যের লাল আভা। যেন দরজা খুলে পা বাড়ালেই সাগরের বালুতে ডুবে যাবে পা। সমুদ্রের লোনা পানি এসে ধুয়ে দিয়ে যাবে।

এই রুমগুলোকে বলা হয় বিচ বাংলো। রুম থেকে বের হলে কাঠের বারান্দার সামনেই ঘাসের ওপর তরতর করে বেড়ে উঠছে একটি বড়ই গাছ। এরই মধ্যে সূর্য আরও আলো নিয়ে ধরা দিতে থাকে। যেন দিনের আলোকে ঠেলে নিয়ে আসছে সাগরের ঢেউ। বিচ বাংলোর এই রুমগুলোতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা রয়েছে। কারণ একেবারে বাংলো থেকে না বের হলে পাশের বাংলোর কাউকে চোখে পড়ে না।

বিজ্ঞাপন

গেলো ফেব্রুয়ারির ছুটির দিনগুলো যেন কেটেছে এক আভিজাত্যময় বিশ্রামে। যেখানে চাইলেই নিজেকে নিয়ে ভাবা যায়। সময়কে বেধে রাখা যায়। নিজের জন্য নিজের যত্ন নেয়া যায়। পেঁচার দ্বীপের এই মারমেইড বিচ রিসোর্টে প্রতিটি খাবারই সতেজ আর সজীব। সাগরের সতেজ হাওয়া আর সজীব খাবার আর নিজের একান্ত সময় এই হচ্ছে মারমেইড লাইফ।

কক্সবাজার থেকে পশ্চিমে মেরিন ড্রাইভ ধরে এগোলে বাম পার্শ্বে পাহাড় আর ডান পার্শ্বে ঝাউ গাছের সারি। এরপর বালুচর আর সাগরের ঢেউ। হিমছড়ি পেরিয়ে ইনানী পৌছানোর আগেই পেঁচারদিয়া গ্রামে গড়ে উঠেছে পেঁচার দ্বীপ। আর সেখানে রেজু খালকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মনোরম মারমেইড বিচ রিসোর্ট।

বিজ্ঞাপন

এখানের বিচের পাশে কাঠের উচুঁ পাটাতনে হাঁটার জায়গা। পাটাতন ধরে ঝুলছে বড় ডিম্বাকৃতির বাতি। সেখানে একটি নৌকা এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যেন বহু বছর আগে এখানে এসে হারিয়ে গিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন নিমো।

হরেক রকমের গাছকে এড়িয়ে নীল সাগরের পাড়ে নামলে সেখানে দৌড়ে বেড়াচ্ছে লাল কাঁকড়ার দল। এই কাঁকড়াদের সঙ্গে খেলে বেড়ানো যায় ঘণ্টা ধরে। কয়েকটি কাঁকড়া যেন আমাকে দেখেও দাঁড়িয়ে ছিল! কৌতুহল নিয়ে একটু একটু করে এগোতেই দৌড়ে বর্ষা-তলোয়ার নিয়ে বালুর ভেতরে গোপন ডেরায় ঢুকে যায় তারা।

এখানে রুমগুলো নির্মাণে প্রাকৃতিক বস্তুই ব্যবহৃত হয়েছে বেশি। আবার স্রেফ কুটিরের মতোই রয়েছে কিছু ঘর। তবে আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা রয়েছে ভেতরে। যেমন গোসলখানাটাই সাজানো হয়েছে খুব প্রাকৃতিক ভাবে। প্লাস্টিকের বোতলের শ্যাম্পুর বদলে কাঁচের শিশিতে দেয়া হয়েছে ভেষজ শ্যাম্পু। এখানকার ইয়োগা সেন্টার, স্পা, নৌকা ভ্রমণ, ব্যায়ামাগারে ঘুরেও নিজেরে অবসরকে উদযাপন করা যায়। 

এই পুরো রিসোর্ট জুড়েই রয়েছে ফুলের ছড়াছড়ি। আর ফুলগুলো ফুটেও কিন্তু এই মারমেইড রিসোর্ট আঙ্গিনাতেই। সকালে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে হয়তো একটি টেবিলে পানির বোতলের পাশে সাঁজিয়ে রাখা হয়েছে দুটি জবা ফুল। আর এখানে প্রবেশের দিনই স্বাগত পানীয় হিসেবে থাকে সদ্য গাছ থেকে পারা ডাব। আর ফুলের কথা যদি বলা হয়, তবে পুরো মারমেইডই ফুলের বাগান।

নেই কোন কোলাহল। কোন যন্ত্রের হাঁকডাক পাওয়া যাবে না। বিকেলের রোদ যখন পড়ে যেতে থাকে তখন কুঠির বা বাংলার সামনের বেঞ্চে গাঁ এলিয়ে দিয়ে সূর্যাস্তটা যেন জীবনের সিনেমার মতোই মনে হবে। রয়েছে নৌকা নিয়ে রেজু খালে ভ্রমণ করে সন্ধ্যার আলো আর অন্ধকারে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ।

ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে তখন ভারা পূর্ণিমা। এখানে সাগরপাড়ে খাটিয়াতে শুয়ে আকাশপানে তাকালাম। পুরো চাঁদটা যেন আমার। আর তুলার মতো ভেসে বেড়ানো মেঘকে পর্দা বানিয়ে চাঁদ যেন লুকোচুরি করতে চাইছে।

 

এখানে রয়েছে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা। আর মারমেইডের নিরাপত্তা রক্ষী আর কর্মীরাও নিয়োজিত থাকেন সবসময় নিরাপত্তায়। তাই ভাটার সময় সাগরে যেতে চাইলে বাধার মুখে পড়তে হবে।

মারমেইডের সবচেয়ে আকর্ষনীয় সেবার মধ্যে অবশ্যই খাবার। সমুদ্রের পারে সামুদ্রিক মাছের প্রাধান্য থাকবে, এটাইতো স্বাভাবিক। তবে লবস্টার, স্কুইড আর চিংড়ির দিয়েই রয়েছে ৪০ এর ওপর খাবার। আর এখানে যে মুরগির মাংস খাওয়ানো হয়, এই মুরগিগুলো স্থানীয় গ্রাম থেকেই কেনা হয়। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, খাবারের মশলা আর অন্যান্য উপাদান। ধনিয়া, লেটুস, পুদিনা আর অন্য সবজিগুলো এখানেই চাষ করা হয়। আর এখানকার কর্মীরাই সেখানে নিজেদের এই শখের কাজগুলো করে থাকে।

মারমেইডের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিকের সঙ্গে কথা হলো এসব নিয়ে। তিনি বললেন, এখানে বাজারের সেরা মশলাটা নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। আর গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী সকল সম্ভাব্য সেবাই আমরা প্রদান করে থাকি।

তিনি বলেন, এখানে কর্মীদের মানবিক মূল্যবোধ এবং দায়িত্ব সর্ম্পকে সচেতন করা হয়, শিক্ষা দেয়া হয়। কর্মীরা যেন নিজেদের কাজটিকে ভালবাসতে পারে, এই প্রতিষ্ঠানটিকে ভালবাসতে পারেন, সেই চেষ্টা করা হয়। আর সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আগত অতিথিদের সেবা দেয়া।

মারমেইডের রেস্টুরেন্ট একেবারে সাগর পাড়ে। এখানে সন্ধ্যায় বসলে যেমন সাগরের গর্জন কানে আসবে তেমনি হিমেল হাওয়ায় মৃদু সঙ্গীতের সুর যেন অন্য এক মায়ার দুনিয়ায় প্রবেশ করায়। রেস্টুরেন্টে অতিথির জন্যে সেরা সব খাবার তৈরি করেন শেফ মোহাম্মদ রাজু। তিনি বলেন, এখানে অনেক বিদেশি অতিথিও আসেন। তারা বিভিন্ন ধরনের স্বাদে খাবারের কথা বলেন। যেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে মান ধরে রাখি আমরা। খাবারে উপাদানে যেসব ভেষজ ব্যবহৃত হয়, সেগুলো সবগুলোই এখানে চাষ হয়। আর আমাদের খাবার তৈরির ক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ যত্ন দিয়ে থাকি।

কাঁঠালিচাপা ও  শুভ্র স্পাইডার লিলিফুলের গন্ধ নাগরিক ব্যস্ততা থেকে পালানো ক্লান্ত মনকে চাঙ্গা করে তোলে। এখানে বিভিন্ন রিসাইকলড ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ভাস্কর্য। গাছের ডালে ডালে রং বেরং এর লণ্ঠন, দেয়ালের গ্রাফিতি, মজার মজার সব ফ্রেম আর তৈলচিত্রের প্রদর্শন মারমেইডের বাঁকে বাঁকে চিত্রপট পাল্টে দেয়।

মারমেইডে ব্যস্ততার সময় যেমন থমকে থাকে, তেমনি অবসর আর সুস্থ্য সময়টা কাটতে থাকে দিনের আলোর সঙ্গেই। মারমেইডের ভালবাসা ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করবে না। প্রকৃতির অমোঘ মায়ায় জড়িয়ে রাখতে চায়।