নারীশ্রমে বাঁচলো মৃতপ্রায় নদী!
ভারতে সম্ভাব্য পানি সংকটের পদধ্বনিতে আশাবাদী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন দেশটির নারীশক্তি। মৃতপ্রায় নদী বাঁচাতে ২০০০০ মহিলা নিরলস প্রচেষ্টা চালালেন দীর্ঘ চার বছর। নারীশ্রমে নবপ্রাণ পেয়ে বাঁচলো নদী।
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের যে ভেলোর পরিচিত, সেখানে নাগানধি নদী পেলে নতুন জীবন। বহু মানুষও বেঁচে গেলেন তীব্র পানিকষ্ট থেকে।
তামিলনাড়ুর যে ২৪টি জেলা খরাপ্রবণ, তার মধ্যে অন্যতম ভেলোর। এই ভেলোরের মানুষদের কাছে বেঁচে থাকার, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পানির উৎস ছিল একমাত্র এই নাগানধি।
কিন্তু ১৫ বছর আগে এই নদীটি শুকিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে যায়। নারীশ্রম মৃত নদীকে নবজন্ম দিয়েছে। ফলে মানুষ, প্রকৃতি ও কৃষি সম্ভাব্য ক্ষয় থেকে রক্ষা পেয়েছে।
দক্ষিণ ভারত থেকে শত মাইল দূরে ভারতের উত্তর দিকেও একই ছবি দেখা গেছে। উত্তরাখণ্ডের পউরি গাড়ওয়ালের প্রায় ১০০ জন গ্রামবাসী ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে নানা মাপের রিজ়ার্ভার তৈরি করছেন। পানির স্বল্পতার কবল থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছা শ্রম ও স্বেচ্ছা প্রণোদনায় এগিয়ে এসেছেন মানুষ। যে মানুষের মধ্যে অগ্রণী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন গ্রামের নারীরা।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে বার বার জানাচ্ছে যে, ২০৩০ সাল নাগাদ ভারতের বড় বড় অনেক শহরই চরম পানি সংকটের মুখোমুখি হবে। এরই মাঝে চেন্নাই প্রভৃতি শহরে পানি স্বল্পতা ও সংকটের আঁচ পড়েছে।
আরও পড়ুন: চেন্নাইয়ে পানির তীব্র সংকট
ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামেও যে পানির ভয়াবহ সংকট হাতছানি দিচ্ছে, তা সারা বিশ্বের সামনে স্পষ্টভাবে চিত্রিত হয় নদী উদ্ধারের এই ঘটনাগুলো থেকেই। ভেলোরের ক্ষেত্রে ২০ হাজার মহিলার ৪ বছরের প্রচেষ্টায় ১৫ বছর আগে শুকিয়ে যাওয়া নাগানধি নদীকে আবারও স্রোতস্বিনী করা প্রচেষ্টার পাশাপাশি বহু গ্রামে পানির জন্য রিজার্ভার, কুয়া, জলাধার তৈরি করছে মানুষ, যাতে প্রচুর নুড়ি পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘নাগানধি বাঁচাও’ প্রকল্পের ডিরেক্টর চন্দ্রশেখরণ কুপ্পান বলছেন, 'কোনও নদীকে পুনরায় বাঁচিয়ে তোলার জন্য শুধু তার বহমানতার দিকে নজর দিতে হয়, তা নয়। নদীর গভীরতাও যাতে ঠিক থাকে সেদিকেও নজর দিতে হয়। এক্ষেত্রে বৃষ্টির পানিও যাতে মাটি শুষে নিয়ে জমিয়ে রাখে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই বৃষ্টি হলে সেটা এজাতীয় নদীর ক্ষেত্রে খুব কাজে দেয়। '
উল্লেখ্য, নদীটি মৃতপ্রায় হলে ভেলোরের অর্ধেকের বেশি কৃষক পানির অভাবে গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে থাকেন। কারণ তারা চাষের জন্য পানি পাননি দীর্ঘদিন। নদী নতুন জীবন পাওয়ায় বেঁচেছে জনপদ, কৃষি ও কৃষক।
ভেলোরের আগে দক্ষিণ ভারতের আরেক জায়গায় একই সংকট ঘণীভূত হয়েছিল। কর্ণাটকের বেদবতী এবং কুমুদবতী নামে দুটি নদীও সংস্কারের অভাবে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। দুটি নদীকেই স্বেচ্ছাশ্রমে পুনরায় নাব্যতা দিয়েছিলেন স্থানীয় মানুষ, যাদের সিংহভাগ ছিলেন গ্রামীণ নারী।
পানি সংকটের সম্ভাব্য বিপদ থেকে বাঁচতে ভারতীয় গ্রামের নারীরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। তারা গ্রামে গ্রামে রিজার্ভার বা কুয়া বানাচ্ছেন। দক্ষিণ ভারতের কান্যায়মবাদি ব্লকের সালামানাথাম গ্রামের একজন নারী একাই প্রায় ৩৬ টা কুয়া খুঁড়েছেন।
উত্তর ভারতেও এমন ঘটনা ঘটছে। সেখানে পউরি গাড়ওয়ালের ১৩ বছরের ছাত্রী দীপা রাওয়াত এবং তার বন্ধু স্কুল শেষে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য রিজ়ার্ভার তৈরি করতে মাটি খুঁড়ে চলে আজকাল। সেখানকার সরকারি স্কুলগুলো প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকেই এই কাজে উৎসাহ দেয়। বলা হয়েছে, এক একটি রিজ়ার্ভার যাতে অন্তত ২ ফুট গভীর হয় সেদিকে নজর দিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'শহরের পাশাপাশি গ্রামগুলোতে মানুষের সচেতন হওয়া খুব জরুরি এখনই। যাতে ভবিষ্যতের জন্য তারা পানি সঞ্চয় করে রাখতে পারেন। নইলে সমস্যা বাড়বে। কারণ গ্রামগুলো দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। জলের উৎসও কমছে। দিন দিন জল যত কমবে লোকজন চলে যাবেন এই এলাকা থেকে। তাই গণ সচেতনতা ও অংশগ্রণ ছাড়া এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে মুক্তির কোনও আশা নেই।'