গুজব মন্ত্রী গোয়েবলস



তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
হিটলার এবং গোয়েবলস

হিটলার এবং গোয়েবলস

  • Font increase
  • Font Decrease

গুজব শব্দটার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে নানা কারণে নানা প্রকারের গুজব ছড়ানো হয়েছে। আর এসব কিছুই ব্যবহার করা হয়েছে কোনো বিশেষ দলের বা মহলের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য। কখনো কাউকে চাঁদে দেখতে যাওয়ার গুজব আবার কারো মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে একটা মহল তার স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছে সবসময়। আবার কখনো সত্য ঘটনাকে গুজব বলে গুজব ছড়িয়েছে কেউ কেউ। কিন্তু এই গুজব ছড়ানোতে যেই ব্যক্তি সবচেয়ে ওস্তাদ ছিলেন তার নাম গোয়েবলস। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের হয়ে নানা প্রকার গুজব ছড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন।

‘এটি গোয়েবলসীয় মিথ্যা’ কিংবা ‘এটি গোয়েবলসীয় মিথ্যাকেও হার মানাবে’—এমন একটা কথা আমরা প্রায়ই লোকমুখে বা বই পুস্তকে শুনে থাকি। প্রশ্ন আসতে পারে কে এই গোয়েবলস? অবাক হলেও সত্যি তিনি ছিলেন একজন “গুজব পরিচালনা” মন্ত্রী। আর তাকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘাতক এডলফ হিটলার। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন “মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট এন্ড প্রোপাগান্ডা” নামে একটি আলাদা বিভাগ তৈরি করেন হিটলার। আর এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকে গোয়েবলসের ওপর।

পল জোসেফ গোবলসের জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৮৯৭ সালে জার্মানির রিদত শহরে। ১৯২১ সালে তিনি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেন। এছাড়া ব্যাংকের করণিক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি একজন লেখক হতে চাইতেন। তার লেখার হাতও ছিল চমৎকার। যে কোনো সধারণ বিষয়কে মাখন লাগিয়ে খুবই সুস্বাদু করে উপস্থাপন করতে পারতেন। রস, রঙহীন যে কোনো বিষয়কে তিনি তার দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা দিয়ে রাঙিয়ে দিতে পারতেন। উপন্যাস এবং বেশ কয়েকটি নাটকও রচনা করেছিলেন তিনি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/16/1563264828462.jpg
সন্তানদের সঙ্গে গোয়েবলস ◢

 

প্রোপাগান্ডা বা গুজব শব্দটি শুরুতে একটি ইতিবাচক শব্দ ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে তাদের সেনা এবং জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রেষণা যোগানোর জন্যে এর ব্যবহার শুরু করে। এডলফ হিটলারও বুঝতে পেরেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের এমন পরাজয়ের কারণ আর কিছু নয় বরং ব্রিটিশদের এমন গুজব ছড়ানো। তাই হিটলার আলাদা মন্ত্রণালয় খোলেন এই প্রোপাগান্ডা রুখতে। নাম দেন “মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট এন্ড প্রোপাগান্ডা”। আর এর প্রধান করেন তার সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী “দ্য লিটল ডক্টর” নামে পরিচিত গোয়েবলসকে, যিনি প্রোপাগান্ডা শব্দটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। আর তাই এখনো পৃথিবীজুড়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক জনপ্রিয় “গোয়েবলসীয় কায়দা”।

তিলকে তাল বানানোতে ওস্তাদ এই ব্যক্তি ছোটবেলা থেকেই দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তার ডান পা ছিল বাম পা অপেক্ষা মোটা এবং ছোট। আর এই শারীরিক অক্ষমতার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু তিনি সেই দুর্বলতা দূর করেছিলেন তার তুখোড় ভাষণ ও লেখনী শক্তি দ্বারা।

১৯২২ সালে অ্যাডলফ হিটলারের বক্তৃতা শুনেই তার জীবনের ধারা পাল্টে যায়। যোগ দেন হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে (নাৎসি পার্টি)। যোগদান করেই শুরু করেন তার ম্যাজিক দেখানো। যা কস্মিনকালেও ঘটার সম্ভাবনা নেই, এমন ঘটনা ঘটেছে রব তুলতে তার জুড়ি ছিল না। বাচনশৈলি ও অন্যান্য যোগ্যতা দিয়ে সামান্য একটা বিষয়কে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলতেন তিনি। আর তা করতেন অত্যন্ত গোপনভাবে। বিষয়গুলো এতই গোপন থাকত যে তার একান্ত সচিবও এসব জানতেন না। গোয়েবলসের সচিব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা ব্রুনহিল্ড পমসেল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি জানি, এখন আমাদের আর কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই মনে করে আমরা সব গুজবের ব্যাপারে জানতাম। আসলে তা না। আমরা কিছুই জানতাম না। সবকিছুই আমাদের থেকে গোপন রাখা হতো।

এখনকার এই ইন্টারনেটের যুগে গুজব ছড়ানো কোনো কঠিন বিষয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মুহূর্তেই তিলকে তাল বানিয়ে পৌঁছে দেওয়া যায় হাজার হাজার মানুষের কাছে। কিন্তু তখন এত সহজ ছিল না। তাই হিটলার আর গোয়েবলস মিলে আঁটলেন এক বিশাল ফন্দি। তারা সবাইকে বিনামূল্যে রেডিও উপহার দিতে শুরু করেন। আর তার পরেই শুরু হয় আসল খেলা। রেডিওতে গুজবের বেসাতি ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়া আর স্বজাতির মনে সরকারের আনুগত্য সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে নিত্য নতুন গল্প বানাতে থাকেন তিনি। এভাবেই ক্রমান্বয়ে হিটলারের একজন বিশ্বস্ত সহযোগীতে পরিণত হন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/16/1563264583854.jpg
ফ্রি রেডিও বিতরণ ◢

 

হিটলার ছিলেন প্রতিশোধের নেশায় মত্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে তখনকার পরাশক্তি ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের কাছে এই মর্মে নাকে খত দিয়েছে যে তারা আর যুদ্ধ করবে না। এখন থেকে শান্তির পথে চলবে তারা। এই অপমান সইতে পারেননি হিটলার। হিটলার এবং গোয়েবলস দুজনেই বিশ্বাস করতেন, ভালো এবং সময়োপযোগী একটি স্ক্রিপ্ট এবং একটি দৃষ্টিনন্দন ছবি যে কোনো আদর্শ প্রচারের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। কেননা ব্রিটিশরা এই অস্ত্র ব্যবহার করেই হারিয়ে দিয়েছিল জারমানদের। মূলত এ কারণেই, প্রোপাগান্ডাকে তারা প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন। গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন, শুধুমাত্র হিটলারের মেধাবী এবং অতুলনীয় নেতৃত্বের মাধ্যমেই জার্মানির হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়া সম্ভব।

গোয়েবলস তার লেখাগুলো জনসম্মুখে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে নানা রকম উপায় ব্যবহার করতেন। এরমধ্যে অন্যতম হলো বিশাল জনসমাবেশ করা। তার অসাধারণ লেখনিগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেই বিশাল সমাবেশের আয়োজনও করা হতো বিশালভাবে। নানা রকম আতশবাজি, প্যারেড, জাতীয় সঙ্গীতের সাথে থাকত ব্যাপক আলোকসজ্জা, আর বাহারি রঙের পোস্টার। ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন এমন জায়গায় স্থাপন করা হতো যাতে হিটলার এবং তার ভাষণ দেশের প্রতিটা মানুষের কানে পৌঁছে যেতে পারে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/16/1563264655343.jpg
নাৎসি পার্টির বিশাল সমাবেশের একটি চিত্র ◢

 

তার সবচেয়ে বড় প্রপাগান্ডা ছিল হিটলারকে সকল জার্মানবাসীদের কাছে একজন ত্রাণকর্তা হিসেবে পৌঁছে দেওয়া। আর তাই তিনি হিটলারের নামে এমন সব স্তুতি গাইতেন যেগুলো শুনতে সত্যের মতোই মনে হতো। গুয়েবলসের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, “আপনি যদি একটি বিশাল মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন, তাহলে মানুষজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।” আর তাই তিনি বারবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাবেশে হিটলার এবং জার্মান বাহিনীকে নিয়ে নানা মিথ্যা গুজব ছড়াতেন যেগুলাতে হিটলারকে একজন কিংবদন্তি এবং জার্মান বাহিনীকে যুদ্ধে অবশ্যই বিজয়ী বলে মনে হতো সকলের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলার প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদি নিধন করেন। যেটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সেই ইহুদি হত্যার জন্য কিন্তু জার্মানরা হিটলারকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। তার পেছনেও ছিল এই গোয়েবসের প্রপাগান্ডা। ১৯২৪ সালের ৪ জুলাই তিনি লেখেন, “জার্মানিতে এখন একজন শক্ত মানুষের দরকার। জার্মানিকে নিয়ে সব রকমের নিন্দা আর অন্যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ হওয়া দরকার। আমাদের এখন সর্বস্ব উজাড় করে কাজ শুরু করতে হবে। এই ইহুদিদের আমরা চাই না। কারণ তারা কখনো সত্যিকার জার্মান নয়। ওদের কঠিন শাস্তি দেওয়া দরকার। এরা কেবল সমস্যাই তৈরি করছেন।” তিনি হিটলারের গুণগান গেয়ে বলেন, “দারুণ খরায় পৃথিবী যেমন হাহাকার করে বৃষ্টির জন্য, তেমনি জার্মানিও এখন এমন এক মানুষের জন্য হাহাকার করছে যে তাদেরকে এই দৈন্যদশা থেকে উদ্ধার করবে। আর তিনি অন্য কেউ নন, তিনি আমাদের মহামতি স্যার এডলফ হিটলার।” এরপরেই মেরে ফেলা হয় লাখো ইহুদিকে, বিনা প্রশ্নে, বিনা বাধায়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/16/1563264965543.jpg

গোয়েবলস এবং তার পরিবার ◢

 

তার এসব প্রপাগান্ডার ফলে জার্মানরা ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করে একমাত্র হিটলার পারেন জার্মানের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু গোয়েবলস জানতেন, তারা যদি পরাজিত হন তবে বিশ্ববাসী তাদের আর কখনো এমন চোখে দেখবে না। তাই তিনি বলেন, “আমরা ইতিহাসে ঠাঁই পাব হয় সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র অধিনায়ক অথবা সর্বশ্রেষ্ঠ অপরাধী হিসেবে।”

হিটলারকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতেন তিনি। “সত্য কোনো রাষ্ট্রের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ শত্রু” বিবেচনা করা এই লোক মারা যান হিটলারের মৃত্যুর ঠিক পরের দিন। পরাজয় নিশ্চিত জেনে অবশেষে ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে হিটলার সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। ঠিক তার পরের দিনই ১ মে গোয়েবলস তার মেয়ের জন্মদিনে প্রথমে তার ছয় সন্তান এবং স্ত্রীকে হত্যা করেন। পরে নিজেও তার প্রিয় নেতা হিটলারের পন্থা অবলম্বন করে আত্মহত্যা করেন।

গোয়েবলস সম্পর্কে তার সচিব পমসেল বলেন, দেখতে খাটো এই লোকটি ছিলেন প্রচুর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। দামি কাপড়ের স্যুট পরতেন, নখের যত্ন নিতেন, ভাষায় ছিলেন খুবই মার্জিত এবং পরিমিত। কে জানত এমন গোছালো একটা ভালো মানুষের আড়ালে এমন একজন ভয়ানক ব্যক্তি ঘাপটি মেরে বসে আছে!

   

আমার হাতের পাখা যেন তাদের আরাম দিচ্ছে!



মৃত্যুঞ্জয় রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাতক্ষীরা
ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

  • Font increase
  • Font Decrease

আবু বক্কর (৬২)। বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে তিনি এখন পাকা বিক্রেতা। প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষ যখন ঠান্ডা বাতাসের প্রশান্তি খুঁজছে, তখন তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন।

আবু বক্কর বার্তা২৪.কমকে বলেন, স্ত্রীসহ ছয় মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। তবে মেয়েদের বিয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু বয়সের ভারে ঠিকই আমরা একা থেকে গেলাম। শেষ বয়সে গ্রামে গ্রামে তালপাতা পাখা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। শুধু সংসার না, এই টাকায় আমার পায়ের শিরার ব্যথার ওষুধও কিনতে হয়। একবেলা ওষুধ না খেলে চলতে পারি না।

এদিকে, পুরনো ব্যবসার ঋণের বোঝা আর অন্যদিকে অসুস্থ হয়ে ওষুধসহ সংসারের খরচ। শেষ বয়সে তালপাতার পাখাই আমার একমাত্র জীবনসঙ্গী বলেন আবু বক্কর।

তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন আবু বক্কর, ছবি- বার্তা২৪.কম

বুধবার (২৪ এপ্রিল) সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কলাগাছি গ্রামের কবিগানের অনুষ্ঠানে সরেজমিন দেখা যায়, একপাশে তালপাতার পাখা বিক্রি করতে ব্যস্ত ছোট্ট পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ। এই গরমে যখন তার ঘরে থাকার কথা, তখন সে নানা-নানীর সঙ্গে এসে তালপাতার পাখা বিক্রি করছে। কবিগানে বসে থাকা সব শ্রোতার কাছে গিয়ে বলছে, পাখা লাগবে, পাখা! কথা বলতে চাইলেও এ পাশ ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, ক্রেতার কাছে।

এক ফাঁকে তাকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই বয়সে পাখা বিক্রি করছো কেন! এ প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে মাহমুদুল্লাহ বলে, প্রচণ্ড গরমে স্কুল ছুটি। তাই, নানা-নানীর সঙ্গে চলে এসেছি মেলায় পাখা বিক্রি করতে। মানুষজন আমার কাছ থেকে যেন বেশি পাখা কেনে (ক্রয়), তাই আমি মেলায় তাদের সঙ্গে এসেছি।

অনেক উৎসাহের সঙ্গে সে বলে, গরমে আমার হাতের পাখায় যেন তাদের আরাম দিচ্ছে! মেলা হলে আমি সেখানে চলে যাই পাখা বিক্রি করতে। ঘোরাঘুরিও হয় আর টাকা ইনকামও হয়। টাকার জন্য বের হয়ে পড়েছি। আমরা পাখা বিক্রি করে পেট চালাই। নানা-নানী বুড়ো হয়ে গেছে। তাই, আমি সঙ্গে এসে তাদের কষ্টটাকে একটু ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।

যেখানে প্রচণ্ড তাপে মানুষজন নাজেহাল, সেখানে ছোট্ট মাহমুদুল্লাহ ছুটে চলেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাখা বিক্রি করতে। ছোট্ট শিশু হলেও গরম যেন তার কাছে কিছু না, পেটের তাগিদে!

আরেক পাখা বিক্রেতা তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা ভদ্রকান্ত সরকার (৭০)। ১২-১৪ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি।

চলছে তালপাতার পাখার বিকিকিনি, ছবি- বার্তা২৪.কম

শেষ বয়সে পাখা কেন বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে ভদ্রকান্ত বলেন, চাল কিনে খেতে হয়। খুব কষ্টের সংসার! ছেলে-মেয়ে আছে। তারা তাদের মতো কাজ করে খায়। মা বাবার বয়স হয়ে গেলে ছেলে আর আমাদের থাকে না। আমরা বৃদ্ধ বয়সে কেমন আছি, সেটা জানার সুযোগ তাদের থাকে না। শেষজীবনটা এভাবে পাখা বিক্রি করে কাটিয়ে দেবো। কী আর করবো! কপালে যা আছে, শেষপর্যন্ত তাই হবে। কপালে ছিল, এমন বৃদ্ধ বয়সে গ্রামে গ্রামে পাখা বিক্রি করতে হবে!

;

৪ লাখ বছর আগে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

  • Font increase
  • Font Decrease

৪ লাখ বছর আগে রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে নতুন এক গবেষণা থেকে জানা গেছে। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে এই গোত্রের মানুষ পরে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায়।

নতুন এক গবেষণা জানাচ্ছে, সাইবেরিয়ায় নতুন একটি এলাকার সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে ৪ লাখ ১৭ হাজার বছর আগে হোমিনিনস (Hominins) গোত্রের মানুষের উপস্থিতি ছিল। এই গোত্রের মানুষ ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বাস করতেন। সেখান থেকে তারা উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায় বলে জানিয়েছেন চেক প্রজাতন্ত্রের এক গবেষক।

১৬ এপ্রিল চেক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষক জন জেনসেন এক সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এ তথ্য প্রকাশ করেন। গবেষণাবিষয়ক সংবাদ সাময়িকী নিউ সায়েন্সটিস্ট এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে জন জেনসেন বলেন, আমরা আগে যে ধারণা করতাম, তারও আগে থেকে হোমিনিনস গোত্রের মানুষ সাইবেরিয়ার ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বসবাস করতেন। ৪ লাখ ১৭ বছর আগে থেকেই তারা এই এলাকায় বসবাস করতে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের অবস্থান ছিল উত্তর অক্ষাংশে।

তিনি বলেন, আরেকটি আদিম গোত্রের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা আর্কটিক অঞ্চলে বাস করতেন। ৪৫ হাজার বছর আগে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 

;

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা



মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

  • Font increase
  • Font Decrease

উদাল, সোনালি হলুদ সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়ানো মাঝারি সাইজের বৃক্ষ। পত্রঝরা উদাম শরীরে পুরো গাছজুড়ে শুধুই সোনালি হলদে রঙের ফুল। বসন্তে হলদে পাপড়ি ঝরে রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা। প্রকৃতির এক অপর সৌন্দর্য উদাল বৃক্ষ ও তার ফুল।

উদাল আমাদের দেশীয় উদ্ভিদ। এদের প্রিয় আবাস পাহাড়ি এলাকা হলেও আগে সারাদেশেই কমবেশি দেখা যেত। নির্বিচারে গাছ উজাড় হতে থাকায় অন্য গাছের সাথে এ দেশী গাছটিও বিপন্ন। ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলা একাডেমি, ঢাকার রমনা পার্ক, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কসহ সমতলের অনেক স্থানে উদাল দেখা যায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পাতাঝরা শালবনের স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে উদাল গাছ দেখা যায়।


উদালের বৈজ্ঞানিক নাম স্টারকুলিয়া ভেলোসা। ইংরেজিতে এটিতে হেয়ারি স্টারকুলিয়া বা এলিফ্যান্ট রোপ ট্রি নামে ডাকা হয়। এ গাছের বাকল থেকে এক প্রকার উন্নতমানের তন্তু পাওয়া যায়। এ তন্তু দিয়ে হাতি বেঁধে রাখার দড়ি বানানো হতো বলেও ইংরেজিতে এমন নামকরণ। আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে এটি চান্দুল নামেও পরিচিত। এই উদ্ভিদ মগ ও মারমাদের কাছে ফিউ বান, গারোদের কাছে উমাক এবং ম্রোদের কাছে নাম সিং নামে পরিচিত।

উদাল ২০ মিটার বা ততোধিক লম্বা হয়। এদের বাকল সাদাটে রঙের। এদের পাতার বোঁটা লম্বা, ফলক বড় ও পাতা খাঁজকাটা, পাতার প্রশাখার আগায় পাতা ঘনবদ্ধ। ফুলগুলি সোনালি হলুদ রঙের, ফুলের ভেতর বেগুনি। এর ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও পাকলে গাঢ় লাল রঙের হয়। বীজের রং কালো। বীজ স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাবার। তবে মানুষও এর ফল খেয়ে থাকে। বাকল থেকে আঁশ পাওয়া যায়। এ আঁশ দিয়ে দড়ি তৈরি হয়। কাঠ বাদামি রঙের, সাধারণত নরম ও হালকা হয়। এই গাছের কাঠ দিয়ে চায়ের বাক্স বানানো হয়।

উদাল ফল খাচ্ছে ইরাবতী কাঠবিড়ালি। ছবি: তবিবুর রহমান

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বার্তা২৪.কম-কে জানান, এ গাছ দেশের বন-জঙ্গলে প্রচুর হতো। এ গাছের পাতার বোঁটা দিয়ে শরবত বানানো হয়। উঁচু গাছ থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়। এরপর এর গোড়া থেকে অনেক নতুন নতুন ডালপালা গজালে সেখান থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও উদাল গাছ থেকে স্বচ্ছ আঠা পাওয়া যায়। যা দিয়ে কনফেকশনারিসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এ উদ্ভিদ বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ তিনশ উদাল গাছের চারা বিভিন্ন স্কুল কলেজে বিতরণ করেছে। এবারও প্রায় পাঁচশ চারা বিতরণ করা হবে।


ড. জসীম বলেন, উদলের বাকলের শরবত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। ফুলের বৃন্ত ছেঁচে জলের সঙ্গে চিনি দিয়ে শরবত করে খেলে প্রস্রাবের সমস্যা ও বাতের ব্যথা দূর হয়। তবে খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রাঙ্গামাটি বনবিভাগের এসিএফ তবিবুর রহমান জানান, উদালের বীজের স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালির খুব প্রিয়। তবে এ বীজ মানুষও খেয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী উদালকে বাংলাদেশের ‘মহাবিপন্ন’ প্রজাতির তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

;

বরিশালের শত বছরের ঐতিহ্যের স্মারক শীতলপাটি



এস এল টি তুহিন, করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের পাটিকররা তাদের নিপুণ হাতের তৈরি শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত।

উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের কাজলাকাঠী গ্রাম, রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঠালিয়া, রাজাপুর গ্রাম ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো তৈরি হয়, ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক দেশ বিখ্যাত শীতলপাটি।

এই উপজেলায় এখন এক হাজারের বেশি পরিবার শীতলপাটি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছে।

উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে প্রবেশ করে যতদূর দু’চোখ যায়, দেখা মেলে পাইত্রাগাছের বাগান। গ্রামীণ সড়কের দুই পাশে দেখা মেলে বড় বড় পাইত্রা বা মোর্তাগাছের ঝোপ। বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত ফসলি জমি, পুকুর পাড়, সব জায়গাতেই বর্ষজীবী উদ্ভিদ তরতাজা পাইত্রাগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের আভিজাত্যের স্মারক শীতলপাটি তৈরি হয়, এই পাইত্রাগাছের বেতি দিয়ে।

জানা গেছে, এসব গ্রামে পাইত্রাগাছের আবাদ হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। পাটিকরদের পূর্বপুরুষেরা যে পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, আজও সেই পেশা ধরে রেখেছেন বাকেরগঞ্জের পাটিকররা।

এখনো এই সব গ্রামে ‘পাটিকর’ পেশায় টিকে আছে প্রায় এক হাজার পরিবার। আর তাদের সবার পেশাই শীতলপাটি বুনন। ফলে, উপজেলার এসব গ্রাম এখন ‘পাটিকর গ্রাম’ নামে পরিচিত।

সরেজমিন দেখা যায়, কাঁঠালিয়া, রাজাপুর ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো গ্রামীণ সড়ক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ছোট ছোট টিনশেড ও আধাপাকা ঘরগুলোর বারান্দায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা মিলে নানান রঙের শীতলপাটি বুনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কাঁঠালিয়া গ্রামের সবিতা রানীর পরিবারের সবাই মিলে দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটান শীতলপাটি তৈরি করতে। একটু সামনে এগুতেই কথা হয়, প্রিয়লাল পাটিকরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, পরিবারের পাঁচ সদস্য মিলে একটি পাটি তৈরি করতে কয়েকদিন চলে যায়। প্রতিজনের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা করেও আসে না। তারপরেও কিছু করার নেই। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এখনো শীতল পাটি বুনে যাচ্ছি। একদিকে, এখন গরম বেড়েছে, অপরদিকে, বৈশাখ মাস চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বৈশাখী মেলায় শীতলপাটির চাহিদা থাকে। তাই, পাইকাররা এসে আমাদের এলাকা থেকে পাটি কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করেন।

স্থানীয় পাটিকররা জানান, এখানকার তৈরি শীতলপাটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু প্লাস্টিক পাটির কারণে বাজারে শীতলপাটির চাহিদা কমে গেছে। সে কারণে সরকারিভাবে বিদেশে শীতলপাটি রফতানির কোনো ব্যবস্থা করা হলে পাটিকরদের জীবন-জীবিকা ভালো চলতো।

পাশাপাশি শীতলপাটি টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা। নয়ত এই পেশায় টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসন, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাসহ জাইকা সংস্থার মাধ্যমে উপজেলার পাটিকরদের মধ্যে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। ফলে, নতুন নতুন ডিজাইনের শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা তাদের সরকারি বিভিন্ন রকম সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

;